in ইতিহাস ও নিদর্শন by
সম্রাট বাবর কি ছিলেন?

3 Answers

+1 vote
by
 
Best answer
মুঘল সম্রাটরা, ১৬ শতকের শুরু থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন করেন। তাদের সাম্রাজ্য মূলত আধুনিক ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত ছিল। মুঘলরা মধ্য এশিয়ার তৈমুর বংশের উত্তর পুরুষ। এই সাম্রাজ্য ১৮ শতকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসকর কর্তৃক ১৮৫৭ সালে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ কে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। [১] মুঘলরা একই সাথে তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। মুঘলদের ভিতরে বেশ কিছু সংখ্যক রাজপুত এবং পারস্যদেশীয় সদস্য ছিল। কারণ অনেক মুঘল সম্রাট পারস্যদেশীয় রাজকন্যা অথবা রাজপুত রাজকন্যাদের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[২][৩] শুধুমাত্র মুঘল সম্রাট বাবর এবং হুমায়ুন ছিলেন প্রকৃত মধ্য এশীয়। আকবর ছিলেন অর্ধেক ইরানি কারণ তার মা ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত। জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন অর্ধ রাজপুত এবং আংশিক পারস্যদেশীয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন এক তৃতীয়াংশ রাজপুত।[৪] তারা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিরাট অংশ জুড়ে তাদের সাম্রাজ্যর বিস্মৃত ছিল। তাদের সাম্রাজ্যের পরিধি বাংলা থেকে কাবুল এবং পশ্চিমের সিন উত্তরের কাশ্মীর এবং দক্ষিণে কাবেরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৫] সেই সময় এই বিশাল এলাকার জনসংখ্যা ছিল ১১০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন। এই জনসংখ্যা তখনকার পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ। মুঘল সম্রাট সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অথবা ১.২ মিলিয়ন বর্গ মাইল। [৬] মুঘল সাম্রাজ্য মুঘলদের বংশ তালিকা। শুধুমাত্র সম্রাটদের প্রধান সন্তানদের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর তার পিতার দিক থেকে সরাসরি তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন। এবং মাতার দিক থেকে তিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। [৭] বাবর মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার পিতার রাজ্য থেকে সেহবাণী খান কর্তৃক বিতাড়িত হবার পর ভারতে আগমন করেন। ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে জয় লাভ করার পর বাবর ভারতে তার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।[৭] বাবরের পুত্র হুমায়ূনের সময় সাম্রাজ্যের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা তাকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে। তিনি পারস্যে পলায়ন করেন।[৭] ইরানের হুমায়ুনের নির্বাসিত সময় পশ্চিম এশীয় সংস্কৃতির সাথে মুঘল দরবারে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ভারতে তার সাম্রাজ্যঃ পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই তিনি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় মারা যান।[৭] সম্রাট হুমায়ুনের শিশুপুত্র আকবর, বৈরাম খান নামে একজন উজিরের তত্বাবধানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট বাবর এর আমলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য সু সংঘটিত হয়।[৭] তিনি ভারতের একটি অনুগত সামরিক অভিজাত শ্রেণী তৈরী করতে পেরেছিলেন এবং একটি আধুনিক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিলেন। বাবর এর আমলে ভারতে সাংস্কৃতিক বিকাশক ত্বরান্বিত হয়েছিল।[৭] একইসাথে আকবর ইউরোপীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ব্যবসা বৃদ্ধি করেছিলেন। আব্রাহাম ইরানি নামে একজন ভারতীয় ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন সেসময় বিদেশিরা মুঘল সাম্রাজ্যের জাঁকজমকপূর্ণ ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ হত। সে সময় জাতীয় সম্পদের এক চতুর্থাংশের মালিক ছিল মাত্র ৬৫৫ টি পরিবার। যখন ভারতের ১২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা একটি বড় অংশ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত ছিল।[৮] ১৫৭৮ সালে আকবর বাঘ শিকার করতে গিয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধারণা করা হয় তিনি মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সেই সময় ইসলাম ধর্মে তার মোহমুক্তি ঘটে। তিনি হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের মিশ্র একটি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।[৯] আকবর ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং দ্বীন-ই-ইলাহী নাম একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।[৭] আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্যকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায়। তিনি আফিমে আসক্ত ছিলেন। মাঝেমধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে উদাসীনতার পরিচয় দিতেন। এক পর্যায়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হন।[৭] জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে মুঘলরা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাজমহল সেসময়কার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।[৭] সে সময় সরকারের ব্যয়, আয় এর চাইতে অনেক বেশি ছিল।[৭] ১৬৫৮ সালে শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো রাজ শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করে। শাহজাহানের অপর পুত্র আওরঙ্গজেব কিছু ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর সহায়তায় দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। ১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেব তার ভাইকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।[৭] যদিও শাহজাহান তখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন, তথাপি আওরঙ্গজেব তাকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করার অযোগ্য ঘোষণা করে তাকে গৃহবন্দী করে রাখেন। আরঙ্গজেব এর আমলে মুঘল সাম্রাজ্য রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী থাকলেও ধর্মীয় বিভেদ মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব কে অনিশ্চিত করে তোলে।[৭] আরঙ্গজেব দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব অঞ্চলেই মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। [৭] আরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষের রাজ্য মধ্য এশিয়ার তুরান জয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাতে সফল হননি। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য বিজয়ের অভিযানে জয়লাভ করলেও যুদ্ধে প্রচুর লোকবল ও সম্পদ ক্ষয় হয়।[১০] আরঙ্গজেব এর জন্য আরেকটি সমস্যা ছিল যে তার সেনাবাহিনীর ভিত্তি ছিল মূলত উত্তর ভারতের অভিজাত শ্রেণী তারাই অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ও অশ্বারোহী বাহিনী সরবরাহ করত। অটোমান সাম্রাজ্যের মত কোন জেনিসারি বাহিনী মুঘলদের ছিল না।[১১] দীর্ঘ দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ আরঙ্গজেব এর অন্যান্য সফলতা কে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছিল। ১৭ শতকের শেষে অভিজাত শ্রেণী মুঘল সম্রাটদের অভিযানে সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো অভিযানের সফলতার পর ভূসম্পত্তি এবং অন্যান্য সম্পত্তি প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা তা ধীরে ধীরে কমে আসছিল।[১২] আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহ আলম তার পিতার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে প্রশাসনে একটি সংস্কার আনতে সচেষ্ট হন। ১৭১৯ সালে তার মৃত্যুর পর সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্য এক বিশৃংখল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। পরপর চারজন সম্রাট সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।[৭] সম্রাট মোহাম্মদ শাহ এর শাসন আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়। মধ্য ভারতের একটি বিরাট অংশ মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একটি এলাকার সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য মুঘলরা সবসময় একটি কৌশল অবলম্বন করতো। তারা এলাকার একটি দুর্গ দখল করতো এবং সেটি কে কেন্দ্র রূপে ব্যবহার করে আশেপাশের শত্রু সেনাদের প্রতিহত করত। মুঘলরা খোলা যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলা করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে বেশি পারদর্শী ছিল। এই কৌশলটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল।[১০] অপরদিকে হিন্দু মারাঠা বীরেরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো না। বরং তারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এম্বুস এবং ছোটখাটো আক্রমণের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীর রসদ সরবরাহ কে পর্যুদস্ত করতো।[১০] মারাঠাদের উপযুক্ত গোলন্দাজ বাহিনী এবং অশ্বারোহী সেনাবাহিনী না থাকায় তারা সরাসরি মুঘলদের দুর্গ আক্রমণ করত না। মুঘলদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ সরবরাহে বাধা প্রদান ও তা ধ্বংস করে দুর্গে অবস্থানরত মুঘল সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতো। [১০] মুঘল সেনাপতিরা মারাঠাদের এই যুদ্ধ কৌশলের বিরুদ্ধে পাল্টা কোন কৌশল গ্রহণ না করায় ক্রমেই মধ্য ভারতের অনেক এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। পারস্য সম্রাট সম্রাট নাদির শাহের ভারত অভিযানের পর মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি এবং গৌরব অনেকটাই কমে আসে।[৭] অনেক সামন্ত শাসকরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজ্য শাসন করতে থাকে। যদিও শুধু মুসলিম অভিযাত্রায় নয়, মারাঠা হিন্দু এবং শিখ নেতৃবৃন্দ মুঘল সম্রাটকে ভারতের আনুষ্ঠানিক সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে মেনে চলত। [১৩] পরবর্তী দশকে আফগান, শিখ এবং মারাঠারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বাইরের শক্তির দ্বারস্থ হতে হয়। ১৭৮৪ সালে মারাঠারা দিল্লীর সালতানাতের পরিরক্ষাকারি হিসাবে ঘোষিত হয়। দ্বিতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বজায় থাকে। এরপরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির মুঘল বংশের পরিরক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়।[১৩] তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাক্তন মুঘল সাম্রাজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হলে, ব্রিটিশ সরকার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে। সেই সাথে বিলুপ্ত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের।[৭] মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।’ কবিতার এই চরণ দুটি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির সম্রাট বাবরকে নিয়ে লেখা। তিনি স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেন। একইসঙ্গে প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল পিতা হিসেবেও স্থাপন করে গেছেন অনন্য নজির। পুরো নাম জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, তবে বাবর নামেই সমধিক পরিচিত। বাবর জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফারগানা (বর্তমানে উজবেকিস্তান) প্রদেশের আনদিজান শহরে। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১২ বছর বয়সেই সিংহাসনে বসেন। তবে চাচার ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হন বাবর। পরে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে হিন্দুকুশের দিকে পা বাড়ান বাবর। ১৫২৯ সালে ঘাঘরার যুদ্ধে আফগানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তানে পাকাপোক্ত একটি অবস্থান গড়ে দেয়। অবশ্য এর আগেই, ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ, খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে সম্রাট বাবর নিজের পরিবারের জন্য হিন্দুস্তানকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন। কাবুল দুর্গে অবস্থানরত তার পরিবারকে আগ্রা আসার অনুমতি দেন। পুরো পরিবার নিয়ে আগ্রা দুর্গে বেশ কিছুদিন শান্তিতেই সময় কাটাতে লাগলেন সম্রাট বাবর। এসময় অবশ্য সাম্রাজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছিলো বাবরকে, তবে এ সময়টুকু তিনি নিজেরমতো করে পরিবারের সঙ্গেই অতিবাহিত করেন। এ সময় তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মাহাম বেগমকে নিয়ে ধোলপুর থেকেও একবার ঘুরে আসেন। কিন্তু এর তিন মাস পরেই বাবরের পরিবারে নেমে আসে বেদনাদায়ক এক বিপর্যয়। হঠাৎ করেই প্রচন্ড পেটের অসুখে মারা যান সম্রাটের এক পুত্র। সম্রাট বাবর ও দিলদার বেগমের এই পুত্রের নাম ছিলো আলোয়ার মির্জা। ঘটনার আকস্মিকতায় পুরো মুঘল পরিবার হতভম্ব, বিমর্ষ। মুঘল রাজদরবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। এরকম থমথমে অবস্থা কাটাতে সম্রাট বাবর আবারও তার স্ত্রীদের নিয়ে ধোলপুরের দিকে যাত্রা করেন। এমন শোকের সময় স্থান বদল করলে হয়তো শোকের তীব্রতা কমে আসবে, এটাই ছিলো পরিবারের প্রধান হিসেবে মুঘল সম্রাট বাবরের একমাত্র আশা। তবে ধোলপুর গিয়েও তেমন একটা স্বস্তি পেলেন না বাবর। কারণ দিল্লি থেকে মাওলানা মুহাম্মদ ফারঘালি একটি পত্র পাঠান। পত্রে বাবরের প্রিয়পুত্র হুমায়ুনের অসুস্থতার খবর জানান মাওলানা ফারঘালি। পত্র পেয়ে বাবর দ্রুত হুমায়ুনকে দিল্লি থেকে রাজধানী আগ্রা নিয়ে আসার নির্দেশ দিয়ে আগ্রার দিকে যাত্রা করেন। তখন বাবরের সঙ্গী ছিলেন হুমায়ুনের মাতা মাহাম বেগম। পুত্রের অসুস্থতার কথা শুনে তিনি ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারান। হুমায়ুন ছিল বাবরের পুত্রদের মধ্যে অত্যধিক প্রিয়। কারণ, হিন্দুস্তান অভিযানের সময় শাহাজাদা হুমায়ুনই সঙ্গ দিয়েছিলেন পিতাকে, সেই সময় থেকে দুজনের মধ্যে আত্মিক বন্ধন গড়ে ওঠে। যা বাবরের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বজায় ছিলো। হুমায়ুনের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছিলো। মাহাম বেগমের মাতৃআবেগ ধীরে ধীরে লাগামছাড়া হয়ে যাচ্ছিলো।
0 votes
by
মুঘল সম্রাটরা, ১৬ শতকের শুরু থেকে ১৯ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন করেন। তাদের সাম্রাজ্য মূলত আধুনিক ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান এবং বাংলাদেশ নিয়ে গঠিত ছিল। মুঘলরা মধ্য এশিয়ার তৈমুর বংশের উত্তর পুরুষ। এই সাম্রাজ্য ১৮ শতকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসকর কর্তৃক ১৮৫৭ সালে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ কে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। [১] মুঘলরা একই সাথে তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। মুঘলদের ভিতরে বেশ কিছু সংখ্যক রাজপুত এবং পারস্যদেশীয় সদস্য ছিল। কারণ অনেক মুঘল সম্রাট পারস্যদেশীয় রাজকন্যা অথবা রাজপুত রাজকন্যাদের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[২][৩] শুধুমাত্র মুঘল সম্রাট বাবর এবং হুমায়ুন ছিলেন প্রকৃত মধ্য এশীয়। আকবর ছিলেন অর্ধেক ইরানি কারণ তার মা ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত। জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন অর্ধ রাজপুত এবং আংশিক পারস্যদেশীয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন এক তৃতীয়াংশ রাজপুত।[৪] তারা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিরাট অংশ জুড়ে তাদের সাম্রাজ্যর বিস্মৃত ছিল। তাদের সাম্রাজ্যের পরিধি বাংলা থেকে কাবুল এবং পশ্চিমের সিন উত্তরের কাশ্মীর এবং দক্ষিণে কাবেরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৫] সেই সময় এই বিশাল এলাকার জনসংখ্যা ছিল ১১০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন। এই জনসংখ্যা তখনকার পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ। মুঘল সম্রাট সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অথবা ১.২ মিলিয়ন বর্গ মাইল। [৬] মুঘল সাম্রাজ্য মুঘলদের বংশ তালিকা। শুধুমাত্র সম্রাটদের প্রধান সন্তানদের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর তার পিতার দিক থেকে সরাসরি তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন। এবং মাতার দিক থেকে তিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। [৭] বাবর মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার পিতার রাজ্য থেকে সেহবাণী খান কর্তৃক বিতাড়িত হবার পর ভারতে আগমন করেন। ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে জয় লাভ করার পর বাবর ভারতে তার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।[৭] বাবরের পুত্র হুমায়ূনের সময় সাম্রাজ্যের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা তাকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে। তিনি পারস্যে পলায়ন করেন।[৭] ইরানের হুমায়ুনের নির্বাসিত সময় পশ্চিম এশীয় সংস্কৃতির সাথে মুঘল দরবারে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ভারতে তার সাম্রাজ্যঃ পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই তিনি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় মারা যান।[৭] সম্রাট হুমায়ুনের শিশুপুত্র আকবর, বৈরাম খান নামে একজন উজিরের তত্বাবধানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট বাবর এর আমলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য সু সংঘটিত হয়।[৭] তিনি ভারতের একটি অনুগত সামরিক অভিজাত শ্রেণী তৈরী করতে পেরেছিলেন এবং একটি আধুনিক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিলেন। বাবর এর আমলে ভারতে সাংস্কৃতিক বিকাশক ত্বরান্বিত হয়েছিল।[৭] একইসাথে আকবর ইউরোপীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ব্যবসা বৃদ্ধি করেছিলেন। আব্রাহাম ইরানি নামে একজন ভারতীয় ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন সেসময় বিদেশিরা মুঘল সাম্রাজ্যের জাঁকজমকপূর্ণ ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ হত। সে সময় জাতীয় সম্পদের এক চতুর্থাংশের মালিক ছিল মাত্র ৬৫৫ টি পরিবার। যখন ভারতের ১২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা একটি বড় অংশ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত ছিল।[৮] ১৫৭৮ সালে আকবর বাঘ শিকার করতে গিয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধারণা করা হয় তিনি মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সেই সময় ইসলাম ধর্মে তার মোহমুক্তি ঘটে। তিনি হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের মিশ্র একটি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।[৯] আকবর ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং দ্বীন-ই-ইলাহী নাম একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।[৭] আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্যকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায়। তিনি আফিমে আসক্ত ছিলেন। মাঝেমধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে উদাসীনতার পরিচয় দিতেন। এক পর্যায়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হন।[৭] জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে মুঘলরা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাজমহল সেসময়কার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।[৭] সে সময় সরকারের ব্যয়, আয় এর চাইতে অনেক বেশি ছিল।[৭] ১৬৫৮ সালে শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো রাজ শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করে। শাহজাহানের অপর পুত্র আওরঙ্গজেব কিছু ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর সহায়তায় দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। ১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেব তার ভাইকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।[৭] যদিও শাহজাহান তখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন, তথাপি আওরঙ্গজেব তাকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করার অযোগ্য ঘোষণা করে তাকে গৃহবন্দী করে রাখেন। আরঙ্গজেব এর আমলে মুঘল সাম্রাজ্য রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী থাকলেও ধর্মীয় বিভেদ মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব কে অনিশ্চিত করে তোলে।[৭] আরঙ্গজেব দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব অঞ্চলেই মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। [৭] আরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষের রাজ্য মধ্য এশিয়ার তুরান জয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাতে সফল হননি। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য বিজয়ের অভিযানে জয়লাভ করলেও যুদ্ধে প্রচুর লোকবল ও সম্পদ ক্ষয় হয়।[১০] আরঙ্গজেব এর জন্য আরেকটি সমস্যা ছিল যে তার সেনাবাহিনীর ভিত্তি ছিল মূলত উত্তর ভারতের অভিজাত শ্রেণী তারাই অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ও অশ্বারোহী বাহিনী সরবরাহ করত। অটোমান সাম্রাজ্যের মত কোন জেনিসারি বাহিনী মুঘলদের ছিল না।[১১] দীর্ঘ দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ আরঙ্গজেব এর অন্যান্য সফলতা কে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছিল। ১৭ শতকের শেষে অভিজাত শ্রেণী মুঘল সম্রাটদের অভিযানে সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো অভিযানের সফলতার পর ভূসম্পত্তি এবং অন্যান্য সম্পত্তি প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা তা ধীরে ধীরে কমে আসছিল।[১২] আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহ আলম তার পিতার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে প্রশাসনে একটি সংস্কার আনতে সচেষ্ট হন। ১৭১৯ সালে তার মৃত্যুর পর সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্য এক বিশৃংখল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। পরপর চারজন সম্রাট সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।[৭] সম্রাট মোহাম্মদ শাহ এর শাসন আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়। মধ্য ভারতের একটি বিরাট অংশ মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একটি এলাকার সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য মুঘলরা সবসময় একটি কৌশল অবলম্বন করতো। তারা এলাকার একটি দুর্গ দখল করতো এবং সেটি কে কেন্দ্র রূপে ব্যবহার করে আশেপাশের শত্রু সেনাদের প্রতিহত করত। মুঘলরা খোলা যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলা করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে বেশি পারদর্শী ছিল। এই কৌশলটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল।[১০] অপরদিকে হিন্দু মারাঠা বীরেরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো না। বরং তারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এম্বুস এবং ছোটখাটো আক্রমণের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীর রসদ সরবরাহ কে পর্যুদস্ত করতো।[১০] মারাঠাদের উপযুক্ত গোলন্দাজ বাহিনী এবং অশ্বারোহী সেনাবাহিনী না থাকায় তারা সরাসরি মুঘলদের দুর্গ আক্রমণ করত না। মুঘলদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ সরবরাহে বাধা প্রদান ও তা ধ্বংস করে দুর্গে অবস্থানরত মুঘল সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতো। [১০] মুঘল সেনাপতিরা মারাঠাদের এই যুদ্ধ কৌশলের বিরুদ্ধে পাল্টা কোন কৌশল গ্রহণ না করায় ক্রমেই মধ্য ভারতের অনেক এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। পারস্য সম্রাট সম্রাট নাদির শাহের ভারত অভিযানের পর মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি এবং গৌরব অনেকটাই কমে আসে।[৭] অনেক সামন্ত শাসকরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজ্য শাসন করতে থাকে। যদিও শুধু মুসলিম অভিযাত্রায় নয়, মারাঠা হিন্দু এবং শিখ নেতৃবৃন্দ মুঘল সম্রাটকে ভারতের আনুষ্ঠানিক সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে মেনে চলত। [১৩] পরবর্তী দশকে আফগান, শিখ এবং মারাঠারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বাইরের শক্তির দ্বারস্থ হতে হয়। ১৭৮৪ সালে মারাঠারা দিল্লীর সালতানাতের পরিরক্ষাকারি হিসাবে ঘোষিত হয়। দ্বিতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বজায় থাকে। এরপরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির মুঘল বংশের পরিরক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়।[১৩] তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাক্তন মুঘল সাম্রাজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হলে, ব্রিটিশ সরকার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে। সেই সাথে বিলুপ্ত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের।[৭] মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।’ কবিতার এই চরণ দুটি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির সম্রাট বাবরকে নিয়ে লেখা। তিনি স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেন। একইসঙ্গে প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল পিতা হিসেবেও স্থাপন করে গেছেন অনন্য নজির। পুরো নাম জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, তবে বাবর নামেই সমধিক পরিচিত। বাবর জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফারগানা (বর্তমানে উজবেকিস্তান) প্রদেশের আনদিজান শহরে। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মাত্র ১২ বছর বয়সেই সিংহাসনে বসেন। তবে চাচার ষড়যন্ত্রের কাছে পরাজিত হয়ে সেখান থেকে বিতাড়িত হন বাবর। পরে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে হিন্দুকুশের দিকে পা বাড়ান বাবর। ১৫২৯ সালে ঘাঘরার যুদ্ধে আফগানদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তানে পাকাপোক্ত একটি অবস্থান গড়ে দেয়। অবশ্য এর আগেই, ১৫২৭ সালের ১৬ মার্চ, খানুয়ার যুদ্ধে রাজপুতদের পরাজিত করে সম্রাট বাবর নিজের পরিবারের জন্য হিন্দুস্তানকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেন। কাবুল দুর্গে অবস্থানরত তার পরিবারকে আগ্রা আসার অনুমতি দেন। পুরো পরিবার নিয়ে আগ্রা দুর্গে বেশ কিছুদিন শান্তিতেই সময় কাটাতে লাগলেন সম্রাট বাবর। এসময় অবশ্য সাম্রাজ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছিলো বাবরকে, তবে এ সময়টুকু তিনি নিজেরমতো করে পরিবারের সঙ্গেই অতিবাহিত করেন। এ সময় তিনি তার প্রিয়তমা স্ত্রী মাহাম বেগমকে।
0 votes
by
মুঘলরা মধ্য এশিয়ার তৈমুর বংশের উত্তর পুরুষ। এই সাম্রাজ্য ১৮ শতকে দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ শাসকর কর্তৃক ১৮৫৭ সালে সর্বশেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ কে ক্ষমতাচ্যুত করার মাধ্যমে মুঘল সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে। [১] মুঘলরা একই সাথে তৈমুর লং এবং চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। মুঘলদের ভিতরে বেশ কিছু সংখ্যক রাজপুত এবং পারস্যদেশীয় সদস্য ছিল। কারণ অনেক মুঘল সম্রাট পারস্যদেশীয় রাজকন্যা অথবা রাজপুত রাজকন্যাদের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।[২][৩] শুধুমাত্র মুঘল সম্রাট বাবর এবং হুমায়ুন ছিলেন প্রকৃত মধ্য এশীয়। আকবর ছিলেন অর্ধেক ইরানি কারণ তার মা ছিলেন পারস্য বংশোদ্ভূত। জাহাঙ্গীর ছিলেন একজন অর্ধ রাজপুত এবং আংশিক পারস্যদেশীয়। সম্রাট জাহাঙ্গীর ছিলেন এক তৃতীয়াংশ রাজপুত।[৪] তারা ভারতীয় উপমহাদেশের একটি বিরাট অংশ জুড়ে তাদের সাম্রাজ্যর বিস্মৃত ছিল। তাদের সাম্রাজ্যের পরিধি বাংলা থেকে কাবুল এবং পশ্চিমের সিন উত্তরের কাশ্মীর এবং দক্ষিণে কাবেরী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[৫] সেই সময় এই বিশাল এলাকার জনসংখ্যা ছিল ১১০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন। এই জনসংখ্যা তখনকার পৃথিবীর এক চতুর্থাংশ। মুঘল সম্রাট সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল ৪ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অথবা ১.২ মিলিয়ন বর্গ মাইল। [৬] মুঘল সাম্রাজ্য মুঘলদের বংশ তালিকা। শুধুমাত্র সম্রাটদের প্রধান সন্তানদের উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর তার পিতার দিক থেকে সরাসরি তৈমুর লং এর বংশধর ছিলেন। এবং মাতার দিক থেকে তিনি চেঙ্গিস খানের বংশধর ছিলেন। [৭] বাবর মাত্র ১৪ বছর বয়সে তার পিতার রাজ্য থেকে সেহবাণী খান কর্তৃক বিতাড়িত হবার পর ভারতে আগমন করেন। ১৫২৬ সালে প্রথম পানিপথের যুদ্ধে জয় লাভ করার পর বাবর ভারতে তার রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।[৭] বাবরের পুত্র হুমায়ূনের সময় সাম্রাজ্যের অবস্থা বেশ নাজুক হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা তাকে ভারতবর্ষ থেকে বিতাড়িত করে। তিনি পারস্যে পলায়ন করেন।[৭] ইরানের হুমায়ুনের নির্বাসিত সময় পশ্চিম এশীয় সংস্কৃতির সাথে মুঘল দরবারে একটি যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ১৫৫৫ সালে হুমায়ুন যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ভারতে তার সাম্রাজ্যঃ পুনরুদ্ধার করেন। কিন্তু এর কিছুদিন পরই তিনি একটি মারাত্মক দুর্ঘটনায় মারা যান।[৭] সম্রাট হুমায়ুনের শিশুপুত্র আকবর, বৈরাম খান নামে একজন উজিরের তত্বাবধানের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সম্রাট বাবর এর আমলে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্য সু সংঘটিত হয়।[৭] তিনি ভারতের একটি অনুগত সামরিক অভিজাত শ্রেণী তৈরী করতে পেরেছিলেন এবং একটি আধুনিক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছিলেন। বাবর এর আমলে ভারতে সাংস্কৃতিক বিকাশক ত্বরান্বিত হয়েছিল।[৭] একইসাথে আকবর ইউরোপীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ব্যবসা বৃদ্ধি করেছিলেন। আব্রাহাম ইরানি নামে একজন ভারতীয় ঐতিহাসিক উল্লেখ করেন সেসময় বিদেশিরা মুঘল সাম্রাজ্যের জাঁকজমকপূর্ণ ঐশ্বর্য দেখে মুগ্ধ হত। সে সময় জাতীয় সম্পদের এক চতুর্থাংশের মালিক ছিল মাত্র ৬৫৫ টি পরিবার। যখন ভারতের ১২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা একটি বড় অংশ দারিদ্র্যে নিমজ্জিত ছিল।[৮] ১৫৭৮ সালে আকবর বাঘ শিকার করতে গিয়ে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধারণা করা হয় তিনি মৃগী রোগে আক্রান্ত ছিলেন। সেই সময় ইসলাম ধর্মে তার মোহমুক্তি ঘটে। তিনি হিন্দু এবং ইসলাম ধর্মের মিশ্র একটি ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন।[৯] আকবর ধর্মীয় স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং দ্বীন-ই-ইলাহী নাম একটি নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন।[৭] আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর মোগল সাম্রাজ্যকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যায়। তিনি আফিমে আসক্ত ছিলেন। মাঝেমধ্যে তিনি রাষ্ট্রীয় কাজে উদাসীনতার পরিচয় দিতেন। এক পর্যায়ে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হন।[৭] জাহাঙ্গীরের পুত্র সম্রাট শাহজাহানের আমলে মুঘলরা অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ ও বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তাজমহল সেসময়কার সবচেয়ে বড় উদাহরণ।[৭] সে সময় সরকারের ব্যয়, আয় এর চাইতে অনেক বেশি ছিল।[৭] ১৬৫৮ সালে শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকো রাজ শাসকের প্রতিনিধি হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণ করে। শাহজাহানের অপর পুত্র আওরঙ্গজেব কিছু ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর সহায়তায় দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। ১৬৫৯ সালে আওরঙ্গজেব তার ভাইকে যুদ্ধে পরাজিত করেন এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।[৭] যদিও শাহজাহান তখন সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন, তথাপি আওরঙ্গজেব তাকে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে রাজকার্য পরিচালনা করার অযোগ্য ঘোষণা করে তাকে গৃহবন্দী করে রাখেন। আরঙ্গজেব এর আমলে মুঘল সাম্রাজ্য রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী থাকলেও ধর্মীয় বিভেদ মুঘল সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব কে অনিশ্চিত করে তোলে।[৭] আরঙ্গজেব দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব অঞ্চলেই মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৭০৭ সালে তার মৃত্যুর পর সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দেয়। [৭] আরঙ্গজেব তার পূর্বপুরুষের রাজ্য মধ্য এশিয়ার তুরান জয় করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তাতে সফল হননি। আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য বিজয়ের অভিযানে জয়লাভ করলেও যুদ্ধে প্রচুর লোকবল ও সম্পদ ক্ষয় হয়।[১০] আরঙ্গজেব এর জন্য আরেকটি সমস্যা ছিল যে তার সেনাবাহিনীর ভিত্তি ছিল মূলত উত্তর ভারতের অভিজাত শ্রেণী তারাই অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ ও অশ্বারোহী বাহিনী সরবরাহ করত। অটোমান সাম্রাজ্যের মত কোন জেনিসারি বাহিনী মুঘলদের ছিল না।[১১] দীর্ঘ দাক্ষিণাত্যের যুদ্ধ আরঙ্গজেব এর অন্যান্য সফলতা কে অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছিল। ১৭ শতকের শেষে অভিজাত শ্রেণী মুঘল সম্রাটদের অভিযানে সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য রসদ সরবরাহ করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ে। এর কারণ হলো অভিযানের সফলতার পর ভূসম্পত্তি এবং অন্যান্য সম্পত্তি প্রাপ্তির যে সম্ভাবনা তা ধীরে ধীরে কমে আসছিল।[১২] আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহ আলম তার পিতার ধর্মভিত্তিক রাজনীতি পরিহার করে প্রশাসনে একটি সংস্কার আনতে সচেষ্ট হন। ১৭১৯ সালে তার মৃত্যুর পর সমগ্র মুঘল সাম্রাজ্য এক বিশৃংখল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। পরপর চারজন সম্রাট সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন।[৭] সম্রাট মোহাম্মদ শাহ এর শাসন আমলে মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙ্গন শুরু হয়। মধ্য ভারতের একটি বিরাট অংশ মুঘলদের হাতছাড়া হয়ে মারাঠাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। একটি এলাকার সামরিক নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য মুঘলরা সবসময় একটি কৌশল অবলম্বন করতো। তারা এলাকার একটি দুর্গ দখল করতো এবং সেটি কে কেন্দ্র রূপে ব্যবহার করে আশেপাশের শত্রু সেনাদের প্রতিহত করত। মুঘলরা খোলা যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলা করে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে বেশি পারদর্শী ছিল। এই কৌশলটি ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল।[১০] অপরদিকে হিন্দু মারাঠা বীরেরা সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতো না। বরং তারা গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে এম্বুস এবং ছোটখাটো আক্রমণের মাধ্যমে মুঘল বাহিনীর রসদ সরবরাহ কে পর্যুদস্ত করতো।[১০] মারাঠাদের উপযুক্ত গোলন্দাজ বাহিনী এবং অশ্বারোহী সেনাবাহিনী না থাকায় তারা সরাসরি মুঘলদের দুর্গ আক্রমণ করত না। মুঘলদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ সরবরাহে বাধা প্রদান ও তা ধ্বংস করে দুর্গে অবস্থানরত মুঘল সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করতো। [১০] মুঘল সেনাপতিরা মারাঠাদের এই যুদ্ধ কৌশলের বিরুদ্ধে পাল্টা কোন কৌশল গ্রহণ না করায় ক্রমেই মধ্য ভারতের অনেক এলাকা তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। পারস্য সম্রাট সম্রাট নাদির শাহের ভারত অভিযানের পর মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি এবং গৌরব অনেকটাই কমে আসে।[৭] অনেক সামন্ত শাসকরা স্বাধীনভাবে তাদের রাজ্য শাসন করতে থাকে। যদিও শুধু মুসলিম অভিযাত্রায় নয়, মারাঠা হিন্দু এবং শিখ নেতৃবৃন্দ মুঘল সম্রাটকে ভারতের আনুষ্ঠানিক সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে মেনে চলত। [১৩] পরবর্তী দশকে আফগান, শিখ এবং মারাঠারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করতে ব্যর্থ চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত তাকে বাইরের শক্তির দ্বারস্থ হতে হয়। ১৭৮৪ সালে মারাঠারা দিল্লীর সালতানাতের পরিরক্ষাকারি হিসাবে ঘোষিত হয়। দ্বিতীয় অ্যাংলো মারাঠা যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বজায় থাকে। এরপরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির মুঘল বংশের পরিরক্ষাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়।[১৩] তখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রাক্তন মুঘল সাম্রাজ্যের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো। ১৮৫৭-৫৮ সালের সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হলে, ব্রিটিশ সরকার শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহকে সিংহাসনচ্যুত করে এবং রেঙ্গুনে নির্বাসিত করে। সেই সাথে বিলুপ্ত হয় মুঘল সাম্রাজ্যের।[৭] মরিয়া বাবর অমর হইয়াছে, নাহি তার কোনও ক্ষয়, পিতৃস্নেহের কাছে হইয়াছে মরণের পরাজয়।’ কবিতার এই চরণ দুটি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা দিল্লির সম্রাট বাবরকে নিয়ে লেখা। তিনি স্বীয় বীরত্ব ও বিচক্ষণতায় ভারতবর্ষে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত রচনা করেন। একইসঙ্গে প্রাণপ্রিয় পুত্র হুমায়ুনের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রদর্শন করে তিনি বিশ্বের ইতিহাসে স্নেহবৎসল পিতা হিসেবেও স্থাপন করে গেছেন অনন্য নজির। পুরো নাম জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর, তবে বাবর নামেই সমধিক পরিচিত। বাবর জন্মেছিলেন ১৪৮৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ফারগানা (বর্তমানে উজবেকিস্তান) প্রদেশের আনদিজান শহরে। তিনি ফারগানা প্রদেশের শাসনকর্তা ওমর মির্জার বড় পুত্র

Related questions

উত্তর সন্ধানী! বেস্ট বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর ওয়েবসাইট। প্রশ্ন করুন, উত্তর নিন, সমস্যা সমাধান করুন ।
উত্তর সন্ধানী কি?
উত্তর সন্ধানী বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর এর ওয়েবসাইট।
গোপন প্রশ্ন ও উত্তর। ডিজিটাল শিক্ষায় প্রশ্নের উত্তরের সেরা ওয়েবসাইট।
...