in ইতিহাস ও নিদর্শন by
আলাউদ্দিন কি ছিলেন?

3 Answers

0 votes
by
 
Best answer
মানব ইতিহাসের বৃহত্তম রাষ্ট্র ছিল দুর্ধর্ষ বিজয়ী চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্য। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চেঙ্গিস খান মোঙ্গলদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলিয়া থেকে চেঙ্গিসের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গলরা বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছিল এবং অসংখ্য রাষ্ট্রকে ধ্বংস বা করতলগত করে তাদের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে জাপান সাগর পর্যন্ত মোঙ্গলদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। উত্তর দিকে উত্তর মেরুর অংশবিশেষ পর্যন্ত, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ইরানি মালভূমি পর্যন্ত এবং পশ্চিম দিকে লেভান্ট ও কার্পেথিয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর সুবৃহৎ মোঙ্গল সাম্রাজ্য ৪টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই খণ্ডগুলো ছিল– চীনকেন্দ্রিক ইউয়ান সাম্রাজ্য, রাশিয়াকেন্দ্রিক সোনালি হোর্ড, ইরানকেন্দ্রিক ইলখানাত এবং মধ্য এশিয়াকেন্দ্রিক চাঘাতাই খানাত। ৪টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়লেও মোঙ্গলদের শৌর্যবীর্য অটুট ছিল, এবং তারা অন্যান্য রাষ্ট্রের নিকট ছিল ত্রাসস্বরূপ। যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল জাতিই কমবেশি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে থাকে, কিন্তু মোঙ্গলরা তাদের বিজিত অঞ্চলে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কয়েকটি উদাহরণ থেকে মোঙ্গলদের যুদ্ধপ্রণালী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১২১৬–১২২২ সালে চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়ার খোরেজম সাম্রাজ্য দখল করে নেন এবং তার সৈন্যরা মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্য প্রসিদ্ধ বুখারা, মার্ভ, নিশাপুর, উরগেঞ্চ প্রভৃতি শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের ফলে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, যা ছিল খোরেজম সাম্রাজ্যের জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ। ১২৩৬–১২৪০ সালে চেঙ্গিসের নাতি বাতু খান রাশিয়া দখল করেন এবং এর ফলে বিলার, বুলগার, মস্কো, রিয়াজান, ভ্লাদিমির, কিয়েভ প্রভৃতি রুশ ও ভোলগা বুলগার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই আক্রমণের ফলে প্রায় ১৬ লক্ষ ভোলগা বুলগার এবং ৫ লক্ষ রুশ নিহত হয়। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান আব্বাসীয় খিলাফতকে ধ্বংস করেন এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বাগদাদ ধ্বংস করেন। এই আক্রমণের ফলে বাগদাদের ৮ লক্ষ থেকে ১৬ লক্ষ অধিবাসী নিহত হয়। ভারতবর্ষেও মোঙ্গলরা বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু ভারতীয়দের জন্য সৌভাগ্যবশত এই আক্রমণগুলোর কোনোটিই ভারতবর্ষ দখল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি। ১২২১ সালে চেঙ্গিস খান খোরেজম সাম্রাজ্যের যুবরাজ জালালউদ্দিনের পশ্চাদ্ধাবন করে ভারতবর্ষের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সিন্ধু নদীর তীরে সংঘটিত এক যুদ্ধে তিনি জালালউদ্দিনকে পরাজিত করেন, কিন্তু এরপর ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২৩৫ সালে মোঙ্গলরা কাশ্মির দখল করে নেয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাশ্মিরে মোঙ্গল শাসন বজায় ছিল। ১২৪১ থেকে শুরু করে ১২৯০ সালের মধ্যে মোঙ্গল–কর্তৃত্বাধীন চাঘাতাই খানাত বেশ কয়েকবার ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালায়, কিন্তু এগুলোর কোনোটিই বড় মাত্রার আক্রমণ ছিল না এবং এই আক্রমণগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন। কিন্তু ১২৯০ এবং ১৩০০–এর দশকে মোঙ্গলরা পরপর ৬ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এবং এর মধ্যে ২ বার দিল্লি দখলের চেষ্টা করে। মোঙ্গলদের প্রতিটি আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর ফলে ভারতবর্ষ মোঙ্গল আক্রমণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পায়। এবং ভারতবর্ষে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার মূল কৃতিত্ব একজন ভারতীয় মুসলিম শাসকের। এই শাসক হলেন দিল্লি সালতানাতের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। আলাউদ্দিন ভারতীয় ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা আলাউদ্দিনকে একজন অত্যাচারী, হিন্দু–নিপীড়নকারী, বিদেশি মুসলিম শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু বাস্তবিক ইতিহাস এতটা সরল নয়। আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের অন্তর্গত, যাদের মধ্যে তুর্কি ও পশতুনদের সংমিশ্রণ ছিল বলে মনে করা হয়। ১২৬৬ সালে তিনি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১২৯০ সালে তার চাচা জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লি সালতানাতের শাসনক্ষমতা দখল করে নেন এবং এর ৬ বছর পর আলাউদ্দিন তাকে খুন করে নিজেই দিল্লির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আলাউদ্দিনের শাসনামল রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিভিন্ন রাজ্য জয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। আলাউদ্দিনকে বিদেশি শাসক হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক, কারণ আলাউদ্দিনের জন্ম ভারতে এবং তিনি বাইরে থেকে আক্রমণ চালিয়ে ভারত দখল করেননি, বরং সেসময় দিল্লি সালতানাত ছিল একটি মুসলিম–শাসিত স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র এবং আলাউদ্দিন ছিলেন সেটির শাসক। আলাউদ্দিন নিষ্ঠুর এবং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারী শাসক ছিলেন, এই বিষয়ে ইতিহাসবিদরা একমত। কিন্তু আলাউদ্দিনের অত্যাচার বা নিষ্পেষণ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি হিন্দু–মুসলিম নির্বিশেষে প্রজাদের অংশবিশেষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এজন্য আলাউদ্দিনকে হিন্দু–নিপীড়নকারী মুসলিম শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তদুপরি, আলাউদ্দিন ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান যিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছিলেন। এমনকি তিনি একটি নিজস্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন বলেও জানা যায়। শাসক হিসেবে আলাউদ্দিন যেমনই হোন, তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল মোঙ্গলদের ছয় ছয়টি আক্রমণ প্রতিহত করা। উল্লেখ্য, আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনামলে ১২৯১–১২৯২ সালে মোঙ্গলরা ভারতবর্ষে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছিল এবং যুদ্ধের মাধ্যমে মোঙ্গলদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে জালালউদ্দিন মোঙ্গলদের প্রদত্ত শর্তানুযায়ী তাদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সংঘর্ষের সময় বহুসংখ্যক মোঙ্গল ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং দিল্লি সালতানাতে বসবাস করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আলাউদ্দিন ক্ষমতা লাভের পর জালালউদ্দিনের শান্তির নীতিকে পরিত্যাগ করেন এবং মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার নীতি গ্রহণ করেন।
0 votes
by
মানব ইতিহাসের বৃহত্তম রাষ্ট্র ছিল দুর্ধর্ষ বিজয়ী চেঙ্গিস খান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মোঙ্গল সাম্রাজ্য। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চেঙ্গিস খান মোঙ্গলদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলিয়া থেকে চেঙ্গিসের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গলরা বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছিল এবং অসংখ্য রাষ্ট্রকে ধ্বংস বা করতলগত করে তাদের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে জাপান সাগর পর্যন্ত মোঙ্গলদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। উত্তর দিকে উত্তর মেরুর অংশবিশেষ পর্যন্ত, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ইরানি মালভূমি পর্যন্ত এবং পশ্চিম দিকে লেভান্ট ও কার্পেথিয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর সুবৃহৎ মোঙ্গল সাম্রাজ্য ৪টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই খণ্ডগুলো ছিল– চীনকেন্দ্রিক ইউয়ান সাম্রাজ্য, রাশিয়াকেন্দ্রিক সোনালি হোর্ড, ইরানকেন্দ্রিক ইলখানাত এবং মধ্য এশিয়াকেন্দ্রিক চাঘাতাই খানাত। ৪টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়লেও মোঙ্গলদের শৌর্যবীর্য অটুট ছিল, এবং তারা অন্যান্য রাষ্ট্রের নিকট ছিল ত্রাসস্বরূপ। যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল জাতিই কমবেশি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে থাকে, কিন্তু মোঙ্গলরা তাদের বিজিত অঞ্চলে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কয়েকটি উদাহরণ থেকে মোঙ্গলদের যুদ্ধপ্রণালী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১২১৬–১২২২ সালে চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়ার খোরেজম সাম্রাজ্য দখল করে নেন এবং তার সৈন্যরা মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্য প্রসিদ্ধ বুখারা, মার্ভ, নিশাপুর, উরগেঞ্চ প্রভৃতি শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের ফলে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, যা ছিল খোরেজম সাম্রাজ্যের জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ। ১২৩৬–১২৪০ সালে চেঙ্গিসের নাতি বাতু খান রাশিয়া দখল করেন এবং এর ফলে বিলার, বুলগার, মস্কো, রিয়াজান, ভ্লাদিমির, কিয়েভ প্রভৃতি রুশ ও ভোলগা বুলগার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই আক্রমণের ফলে প্রায় ১৬ লক্ষ ভোলগা বুলগার এবং ৫ লক্ষ রুশ নিহত হয়। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান আব্বাসীয় খিলাফতকে ধ্বংস করেন এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বাগদাদ ধ্বংস করেন। এই আক্রমণের ফলে বাগদাদের ৮ লক্ষ থেকে ১৬ লক্ষ অধিবাসী নিহত হয়। ভারতবর্ষেও মোঙ্গলরা বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু ভারতীয়দের জন্য সৌভাগ্যবশত এই আক্রমণগুলোর কোনোটিই ভারতবর্ষ দখল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি। ১২২১ সালে চেঙ্গিস খান খোরেজম সাম্রাজ্যের যুবরাজ জালালউদ্দিনের পশ্চাদ্ধাবন করে ভারতবর্ষের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সিন্ধু নদীর তীরে সংঘটিত এক যুদ্ধে তিনি জালালউদ্দিনকে পরাজিত করেন, কিন্তু এরপর ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২৩৫ সালে মোঙ্গলরা কাশ্মির দখল করে নেয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাশ্মিরে মোঙ্গল শাসন বজায় ছিল। ১২৪১ থেকে শুরু করে ১২৯০ সালের মধ্যে মোঙ্গল–কর্তৃত্বাধীন চাঘাতাই খানাত বেশ কয়েকবার ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালায়, কিন্তু এগুলোর কোনোটিই বড় মাত্রার আক্রমণ ছিল না এবং এই আক্রমণগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন। কিন্তু ১২৯০ এবং ১৩০০–এর দশকে মোঙ্গলরা পরপর ৬ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এবং এর মধ্যে ২ বার দিল্লি দখলের চেষ্টা করে। মোঙ্গলদের প্রতিটি আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর ফলে ভারতবর্ষ মোঙ্গল আক্রমণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পায়। এবং ভারতবর্ষে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার মূল কৃতিত্ব একজন ভারতীয় মুসলিম শাসকের। এই শাসক হলেন দিল্লি সালতানাতের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। আলাউদ্দিন ভারতীয় ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা আলাউদ্দিনকে একজন অত্যাচারী, হিন্দু–নিপীড়নকারী, বিদেশি মুসলিম শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু বাস্তবিক ইতিহাস এতটা সরল নয়। আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের অন্তর্গত, যাদের মধ্যে তুর্কি ও পশতুনদের সংমিশ্রণ ছিল বলে মনে করা হয়। ১২৬৬ সালে তিনি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১২৯০ সালে তার চাচা জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লি সালতানাতের শাসনক্ষমতা দখল করে নেন এবং এর ৬ বছর পর আলাউদ্দিন তাকে খুন করে নিজেই দিল্লির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আলাউদ্দিনের শাসনামল রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিভিন্ন রাজ্য জয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। আলাউদ্দিনকে বিদেশি শাসক হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক, কারণ আলাউদ্দিনের জন্ম ভারতে এবং তিনি বাইরে থেকে আক্রমণ চালিয়ে ভারত দখল করেননি, বরং সেসময় দিল্লি সালতানাত ছিল একটি মুসলিম–শাসিত স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র এবং আলাউদ্দিন ছিলেন সেটির শাসক। আলাউদ্দিন নিষ্ঠুর এবং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারী শাসক ছিলেন, এই বিষয়ে ইতিহাসবিদরা একমত। কিন্তু আলাউদ্দিনের অত্যাচার বা নিষ্পেষণ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি হিন্দু–মুসলিম নির্বিশেষে প্রজাদের অংশবিশেষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এজন্য আলাউদ্দিনকে হিন্দু–নিপীড়নকারী মুসলিম শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তদুপরি, আলাউদ্দিন ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান যিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছিলেন। এমনকি তিনি একটি নিজস্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন বলেও জানা যায়। শাসক হিসেবে আলাউদ্দিন যেমনই হোন, তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল মোঙ্গলদের ছয় ছয়টি আক্রমণ প্রতিহত করা। উল্লেখ্য, আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনামলে ১২৯১–১২৯২ সালে মোঙ্গলরা ভারতবর্ষে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছিল এবং যুদ্ধের মাধ্যমে মোঙ্গলদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে জালালউদ্দিন মোঙ্গলদের প্রদত্ত শর্তানুযায়ী তাদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন। উল্লেখ্য, এই সংঘর্ষের সময় বহুসংখ্যক মোঙ্গল ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং দিল্লি সালতানাতে বসবাস করতে শুরু করেছিল। কিন্তু আলাউদ্দিন ক্ষমতা লাভের পর জালালউদ্দিনের শান্তির নীতিকে পরিত্যাগ করেন।
0 votes
by
ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চেঙ্গিস খান মোঙ্গলদের ঐক্যবদ্ধ করেন এবং পূর্ব এশিয়ার মঙ্গোলিয়া থেকে চেঙ্গিসের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গলরা বিশ্বজয়ে বেরিয়ে পড়েছিল এবং অসংখ্য রাষ্ট্রকে ধ্বংস বা করতলগত করে তাদের বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব ও মধ্য ইউরোপ থেকে জাপান সাগর পর্যন্ত মোঙ্গলদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। উত্তর দিকে উত্তর মেরুর অংশবিশেষ পর্যন্ত, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশ, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার মূল ভূখণ্ড ও ইরানি মালভূমি পর্যন্ত এবং পশ্চিম দিকে লেভান্ট ও কার্পেথিয়ান পর্বতমালা পর্যন্ত মোঙ্গল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়েছিল। ১২২৭ সালে চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর সুবৃহৎ মোঙ্গল সাম্রাজ্য ৪টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই খণ্ডগুলো ছিল– চীনকেন্দ্রিক ইউয়ান সাম্রাজ্য, রাশিয়াকেন্দ্রিক সোনালি হোর্ড, ইরানকেন্দ্রিক ইলখানাত এবং মধ্য এশিয়াকেন্দ্রিক চাঘাতাই খানাত। ৪টি খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়লেও মোঙ্গলদের শৌর্যবীর্য অটুট ছিল, এবং তারা অন্যান্য রাষ্ট্রের নিকট ছিল ত্রাসস্বরূপ। যুদ্ধবিগ্রহ পরিচালনার ক্ষেত্রে সকল জাতিই কমবেশি নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিয়ে থাকে, কিন্তু মোঙ্গলরা তাদের বিজিত অঞ্চলে গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের জন্য বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। কয়েকটি উদাহরণ থেকে মোঙ্গলদের যুদ্ধপ্রণালী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১২১৬–১২২২ সালে চেঙ্গিস খান মধ্য এশিয়ার খোরেজম সাম্রাজ্য দখল করে নেন এবং তার সৈন্যরা মধ্য এশিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের জন্য প্রসিদ্ধ বুখারা, মার্ভ, নিশাপুর, উরগেঞ্চ প্রভৃতি শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল আক্রমণের ফলে প্রায় ১৭ লক্ষ মানুষ নিহত হয়, যা ছিল খোরেজম সাম্রাজ্যের জনসংখ্যার এক–চতুর্থাংশ। ১২৩৬–১২৪০ সালে চেঙ্গিসের নাতি বাতু খান রাশিয়া দখল করেন এবং এর ফলে বিলার, বুলগার, মস্কো, রিয়াজান, ভ্লাদিমির, কিয়েভ প্রভৃতি রুশ ও ভোলগা বুলগার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই আক্রমণের ফলে প্রায় ১৬ লক্ষ ভোলগা বুলগার এবং ৫ লক্ষ রুশ নিহত হয়। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিসের নাতি হালাকু খান আব্বাসীয় খিলাফতকে ধ্বংস করেন এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শহর বাগদাদ ধ্বংস করেন। এই আক্রমণের ফলে বাগদাদের ৮ লক্ষ থেকে ১৬ লক্ষ অধিবাসী নিহত হয়। ভারতবর্ষেও মোঙ্গলরা বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালিয়েছিল, কিন্তু ভারতীয়দের জন্য সৌভাগ্যবশত এই আক্রমণগুলোর কোনোটিই ভারতবর্ষ দখল করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়নি। ১২২১ সালে চেঙ্গিস খান খোরেজম সাম্রাজ্যের যুবরাজ জালালউদ্দিনের পশ্চাদ্ধাবন করে ভারতবর্ষের সীমান্তে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সিন্ধু নদীর তীরে সংঘটিত এক যুদ্ধে তিনি জালালউদ্দিনকে পরাজিত করেন, কিন্তু এরপর ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে অগ্রসর না হয়ে প্রত্যাবর্তন করেন। ১২৩৫ সালে মোঙ্গলরা কাশ্মির দখল করে নেয় এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাশ্মিরে মোঙ্গল শাসন বজায় ছিল। ১২৪১ থেকে শুরু করে ১২৯০ সালের মধ্যে মোঙ্গল–কর্তৃত্বাধীন চাঘাতাই খানাত বেশ কয়েকবার ভারতবর্ষের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে আক্রমণ চালায়, কিন্তু এগুলোর কোনোটিই বড় মাত্রার আক্রমণ ছিল না এবং এই আক্রমণগুলোর মূল উদ্দেশ্য ছিল লুণ্ঠন। কিন্তু ১২৯০ এবং ১৩০০–এর দশকে মোঙ্গলরা পরপর ৬ বার ভারতবর্ষ আক্রমণ করে এবং এর মধ্যে ২ বার দিল্লি দখলের চেষ্টা করে। মোঙ্গলদের প্রতিটি আক্রমণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং এর ফলে ভারতবর্ষ মোঙ্গল আক্রমণের বিভীষিকা থেকে রক্ষা পায়। এবং ভারতবর্ষে মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করার মূল কৃতিত্ব একজন ভারতীয় মুসলিম শাসকের। এই শাসক হলেন দিল্লি সালতানাতের সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি। আলাউদ্দিন ভারতীয় ইতিহাসে একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা আলাউদ্দিনকে একজন অত্যাচারী, হিন্দু–নিপীড়নকারী, বিদেশি মুসলিম শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করে। কিন্তু বাস্তবিক ইতিহাস এতটা সরল নয়। আলাউদ্দিন ছিলেন খিলজি বংশের অন্তর্গত, যাদের মধ্যে তুর্কি ও পশতুনদের সংমিশ্রণ ছিল বলে মনে করা হয়। ১২৬৬ সালে তিনি দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১২৯০ সালে তার চাচা জালালউদ্দিন খিলজি দিল্লি সালতানাতের শাসনক্ষমতা দখল করে নেন এবং এর ৬ বছর পর আলাউদ্দিন তাকে খুন করে নিজেই দিল্লির শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। আলাউদ্দিনের শাসনামল রাজনৈতিক নিষ্পেষণ, অর্থনৈতিক সংস্কার এবং বিভিন্ন রাজ্য জয়ের জন্য প্রসিদ্ধ। আলাউদ্দিনকে বিদেশি শাসক হিসেবে অভিহিত করা অযৌক্তিক, কারণ আলাউদ্দিনের জন্ম ভারতে এবং তিনি বাইরে থেকে আক্রমণ চালিয়ে ভারত দখল করেননি, বরং সেসময় দিল্লি সালতানাত ছিল একটি মুসলিম–শাসিত স্বাধীন ভারতীয় রাষ্ট্র এবং আলাউদ্দিন ছিলেন সেটির শাসক। আলাউদ্দিন নিষ্ঠুর এবং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যাচারী শাসক ছিলেন, এই বিষয়ে ইতিহাসবিদরা একমত। কিন্তু আলাউদ্দিনের অত্যাচার বা নিষ্পেষণ ধর্মীয় উদ্দেশ্যে নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হয়েছিল এবং রাজনৈতিক স্বার্থে তিনি হিন্দু–মুসলিম নির্বিশেষে প্রজাদের অংশবিশেষের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন। এজন্য আলাউদ্দিনকে হিন্দু–নিপীড়নকারী মুসলিম শাসক হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না। তদুপরি, আলাউদ্দিন ছিলেন দিল্লির প্রথম সুলতান যিনি ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক করেছিলেন। এমনকি তিনি একটি নিজস্ব ধর্ম প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিলেন বলেও জানা যায়। শাসক হিসেবে আলাউদ্দিন যেমনই হোন, তার শাসনামলের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব ছিল মোঙ্গলদের ছয় ছয়টি আক্রমণ প্রতিহত করা। উল্লেখ্য, আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী সুলতান জালালউদ্দিনের শাসনামলে ১২৯১–১২৯২ সালে মোঙ্গলরা ভারতবর্ষে নতুন করে আক্রমণ চালিয়েছিল এবং যুদ্ধের মাধ্যমে মোঙ্গলদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়ে জালালউদ্দিন মোঙ্গলদের প্রদত্ত শর্তানুযায়ী তাদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন।

Related questions

উত্তর সন্ধানী! বেস্ট বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর ওয়েবসাইট। প্রশ্ন করুন, উত্তর নিন, সমস্যা সমাধান করুন ।
উত্তর সন্ধানী কি?
উত্তর সন্ধানী বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর এর ওয়েবসাইট।
গোপন প্রশ্ন ও উত্তর। ডিজিটাল শিক্ষায় প্রশ্নের উত্তরের সেরা ওয়েবসাইট।
...