শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ বাংলার শাহ[১] বাঙালি জাতির শাহ[২] ন্যায়বিচারক সুলতান লখনৌতির সুলতান রাজত্ব ১৩৪২-১৩৫২ পূর্বসূরি সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহ অবিভক্ত বাংলার সুলতান রাজত্ব ১৩৫২-১৩৫৮ পূর্বসূরি সুলতান ইখতিয়ারুদ্দীন গাজী শাহ উত্তরসূরি সিকান্দার শাহ রাজবংশ ইলিয়াস শাহী রাজবংশ শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ (১৩৪২-১৩৫৮) ছিলেন বাংলার একজন স্বাধীন শাসনকর্তা। তিনি ১৩৪২ সালে সোনারগাঁও বিজয়ের পর লখনৈতির সুলতান হন। শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ অবিভক্ত বাংলার প্রথন মুসলিম স্বাধীন সুলতান ছিলেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা করেন,যা ১৫২ বছর ক্ষ্মতায় ছিলো।[৩] ইলিয়াস শাহী বংশ ১৩৪২ সাল থেকে ১৪১৫ সাল পর্যন্ত একটানা ৭৩ বছর ধরে অবিভক্ত বাংলা শাসন করে এবং এরপর মাঝখানে প্রায় ২০ বছর বাদ দিয়ে আরো ৫২ বছর তাদের শাসন কায়েম থাকে। ইলিয়াস শাহের মৃত্যুর পর তার পূত্র সিকান্দার শাহ ক্ষমতায় আসেন প্রথম জীবন শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ প্রথম জীবনে দিল্লির সালতানাতের অধীনে চাকরি করতেন। কিন্তু কিছু সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার কারণে তিনি বাংলা পালিয়ে আসেন এবং তৎকালীন বাংলায় দিল্লির প্রাদেশিক গভর্নর ইজাজউদ্দীন ইয়াহিয়ার অধীনে কাজ করা শুরু করেন। ১৩৩৮ সালে ইজাজউদ্দীন ইয়াহিয়ার মৃত্যু হলে শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ সাতগাঁওয়ের ক্ষমতা দখল করেন এবং একে দিল্লির অধীন থেকে মুক্ত ঘোষণা করেন। ১৩৪২ সালে প্রায় দুই বছর ধরে চলা যুদ্ধে লখনৈতির সুলতান আলাউদ্দীন আলী শাহকে পরাজিত করে তিনি লখনৌতির শিংহাসনে আরোহণ করেন এবং ইলিয়াস শাহী বংশের সূচনা করেন। অবিভক্ত বাংলা ১৩৫২ খ্রিষ্টাব্দে, তিনি যখন পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাও আক্রমণ করেন তখন ফখরউদ্দিনের পুত্র ইখতিয়ার উদ্দিন গাজী শাহ এর শাসনকর্তা ছিলেন। ইলিয়াস শাহ তাকে বিতাড়িত করে সোনারগাঁও অধিকার করেন।এভাবে তিনি বাংলার তিনটি প্রদেশ যথা সোনারগা ও লখনৌতিকে একত্রিত করে সমগ্র বাংলার অধিশ্বর হোন। কামরুপের কতকাংশ যে ইলিয়াস শাহের রাজ্যভুক্ত ছিল তা তার পুত্র সিকান্দার শাহের রাজত্বের প্রথম বছরে কামরূপের টাকশালে উৎকীর্ণ একটি মুদ্রা হতে বোঝা যায়। এরূপে তার রাজ্যসীমা আসাম হতে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। এছাড়াও তিনি ত্রিহুত অধিকার করেন ১৩৪৪ সালে। তখন কার ত্রিহুতের আত্নকলহই ইলিয়াস শাহকে অনুপ্রানিত করে ত্রিহুত বিজয় করতে। এছাড়াও তিনি নেপালে ১৩৫০ সালে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।শম্ভুনাথের শিলালিপি ও নেপাল রাজবংশাবলিতে ইলিয়াস শাহের নেপাল আক্রমণের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু তার এই সমরাভিযান তার অসাধারণ সেনাপতিত্বের বহিঃপ্রকা। একে একে তিনি উরিষ্যা,চম্পারণ ও গোরক্ষপূর জয় করেন।এছাড়াও ইলিয়াস শাহকে মধ্যযুগের মুসলিম বাংলার ইতিহাসে প্রথম বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা বলা যায়। দিল্লির কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে নিজেকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন।লখনৌতির শাসক হিসেবে বাংলা অধিকার করলেও তিনি বাংলা ভাষাভাষীদের সমন্বয়ে দু ভূখণ্ডকে একত্রিত করে বৃহত্তর সৃষ্টি করেন। এ অখণ্ড ভৌগোলিক রাষ্ট্রিয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ও বাঙালীদের একত্র করার পিছনে তার দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার রাজত্বকালেই বাঙালিরা একটি জাতি হিসেবে আত্নপ্রকাশ করে। এ সময় হতেই বাংলার সকল অঞ্চলের অধিবাসী বাঙালী বলে পরিচিত হয় এবং বাংলার বাইরের দেশগুলোও তাদের কে বাঙালী বলে অভিহিত করে। ইলিয়াস শাহ শাহ ই বাঙ্গালাহ ও শাহ ই বাঙ্গালীউপাধি গ্রহন করে বাঙালীদের জাতীয়নেতা হিসেবে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন। এ কারণে তাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা হিসেবে অভিহিত করা হয়। ১৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে নেপালের তরাই অঞ্চলে এক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করেন। ইতঃপূর্বে কোনো মুসলিম বাহিনী এ অঞ্চলে প্রবেশ করতে পারে নি। তিনি রাজধানী কাঠমুন্ডু পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির ধ্বংস করেন এবং বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তিনি নেপালের কোনো অংশ তার রাজ্যভুক্ত করেন নি। ইলিয়াস শাহ ছিলেন বাংলার প্রথম মুসলমান সুলতান, যিনি সমগ্র বঙ্গদেশকে একত্রীভূত করে সমগ্র বাংলার অধীশ্বর হয়েছিলেন। বাংলার ইতিহাসে নিঃসন্দেহে তিনি একজন কীর্তিমান পুরুষ। সামান্য অবস্থা থেকে স্বীয় যোগ্যতা দ্বারা তিনি বাংলার সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। শুধু বাংলার সিংহাসন লাভ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি ত্রিহুত, নেপাল, উড়িষ্যা ও কামরূপও জয় করেন। বিহার বিজিত হলে চম্পারণ, গোরক্ষপুর ও কাশি পর্যন্ত বঙ্গের রাজ্যসীমা বিস্তৃত হয়। এভাবে ক্ষমতার দিক থেকে তিনি দিল্লির সুলতানের সমকক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। ইলিয়াস শাহ ছিলেন একজন দুঃসাহসী পুরুষ। সুলতান মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকালে তিনি বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। ফিরোজ শাহ তুঘলকের কাছেও তিনি মাথানত করেননি। সুদীর্ঘ ১৫-১৬ বছর যথেষ্ট বিক্রমের সঙ্গে বঙ্গে তার কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন। তিনি যে লৌহকঠিন ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন, তা ফিরোজ শাহের বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ থেকে বোঝা যায়। ফিরোজ শাহের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে। দিল্লির সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করে তিনি বাংলায় রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার পথ নিষ্কণ্টক করেছিলেন। শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ চতুর্দশ শতকে বাংলার সিংহাসন দখল করেন। তখন ছিল বাংলায় মুসলিম শাসনামল।তার প্রধান সাফল্য হলো তিনি দিল্লির সুলতানদের কবল হতে বাংলার স্বাধীনতা বজায় রাখেন। তিনি শাহী বংশের শাসন এর সূচনা করেন। তার শাসনামলে দেশীয় ভাষা, সাহিত্য, পন্ডিত ও কবিদের সমাদর বাড়ে। ইলিয়াস শাহ বাংলাদেশে ইরানের সিজিস্তান হতে আগত এক উদ্বাস্তু ছিলেন। তিনি প্রাথমিক জীবনে বাংলায় নিযুক্ত দিল্লীর গভর্নর আলী শাহের সিলাহদার ছিলেন। কিন্তু পরবরতীতে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে বাংলার সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। ইলিয়াস শাহ বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা দখল করে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে এক সাম্রাজ্য কায়েম করেন । তিনি উত্তর প্রদেশ ও নেপালেরও বিরাট অংশ দখল করে নেন। এর ফলে দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ১৫৫৩ সালে তিনি বাংলা অক্রমণ করেন। ইলিয়াস শাহ বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল দুটো হারিয়ে ফেলেন কিন্তু তিনি বাংলার স্বাধীনতা রক্ষা করতে সক্ষম হন। তিনি ৭৫৯ হিজরি সনের প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৩৫৭ খ্রিস্টাব্দের শেষ অথবা ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে মৃত্যুবরণ করেন।