in অবিশ্বাস্য অজানা by
দ্য টেমপেস্ট কেমন গল্প ছিল?

2 Answers

0 votes
by
 
Best answer
সমুদ্রের বুকে কোনও এক দ্বীপে বাস করতেন দুটি মানুষ – প্রসপেরো নামে এক বৃদ্ধ আর মিরান্দা নামে তাঁর পরমাসুন্দরী যুবতী কন্যা। মিরান্দা খুব অল্প বয়সে এই দ্বীপে এসেছিল। তাই বাবার মুখ ছাড়া আর কোনো মানুষের মুখ তার মনে পড়ত না। তাঁরা বাস করতেন একটা পাথুরে গুহায়। এই গুহায় বেশ কয়েকটি খুপরি ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল প্রসপেরোর পড়ার ঘর। এই ঘরেই তিনি রাখতেন তাঁর বইপত্তর। সে যুগে শিক্ষিত লোকমাত্রই জাদুবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। প্রসপেরোও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তাঁর সংগ্রহের অধিকাংশ বইই ছিল জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত। জাদু জানতেন বলে তাঁর সুবিধাও হয়েছিল কত। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় এই যে দ্বীপটিতে এসে তাঁকে বাসা বাঁধতে হয়েছিল, এই দ্বীপটি আগে ছিল সাইকোরাক্স নামে এক ডাইনির দখলে। সে সময়ে কিছু ভাল অশরীরীর দল তার অন্যায় আদেশগুলি পালন করতে না চাইলে ডাইনি তাদের গাছের কোটরে বন্দী করে রাখে। সাইকোরাক্স মারা যাওয়ার কিছুকাল পরে এই দ্বীপে এসে হাজির হন প্রসপেরো। তিনি নিজের জাদুবলে সেই সব অশরীরীদের মুক্তি দেন। কৃতজ্ঞতার বশে ওই অশরীরীর দলও তাঁর বশংবদে পরিণত হয়। এদের সর্দারের নাম ছিল এরিয়েল। প্রাণোচ্ছ্বল ছোট্ট প্রেত এরিয়েল। তার স্বভাব-চরিত্র মন্দ ছিল না। কিন্তু ক্যালিবান নামে কুৎসিত দৈত্যটাকে জ্বালাতন করতে বড়ো ভালবাসত সে। ক্যালিবান ছিল তার পুরনো দুশমন সাইকোরাক্সের ছেলে। দেখতে শুনতে মানুষের থেকে বনমানুষের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য ছিল বেশি। এই হতভাগ্য প্রাণীটাকে জঙ্গলে কুড়িয়ে পান প্রসপেরো। অবশ্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন নি তিনি। বরং গুহায় নিয়ে এসে যত্ন করেন, কথা বলতে শেখান। কিন্তু মায়ের বদস্বভাব সে পেয়েছিল রক্তের সূত্রে। তাই কোনও ভাল কাজ তাকে শেখানো গেল না। অগত্যা তাকে রাখা হল ক্রীতদাসের মতো করে। কাঠ কুড়ানো আর সব কায়িক শ্রমের কাজগুলি তাকে দিয়ে করানো হতে লাগল। আর তাকে সব কাজ ঠিক ঠাক করিয়ে নেওয়ার দায়িত্বে প্রসপেরো নিয়োগ করলেন এরিয়েলকে। প্রসপেরো ছাড়া এরিয়েলকে দেখতে পেত না কেউই। এরিয়েলের সে ছিল মহাসুযোগ।


কাজে ফাঁকি দিলেই চুপি চুপি এসে ক্যালিবানকে চিমটি কেটে যেত সে। কখনও পাঁকে ঠেলে ফেলে দিত; কখনও বনমানুষের মতো মুখখানি করে ভেংচি কাটত; আবার কখনও কাঁটাচুয়ো হয়ে পড়ে থাকত ক্যালিবানের যাতায়াতের পথে। খালি পায়ে কাঁটা বিঁধে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত ক্যালিবান। প্রসপেরোর আজ্ঞা পালনে কোনও রকম গাফিলতি দেখলেই এই রকম নানা উপায়ে ক্যালিবানকে হয়রান করে ছাড়ত এরিয়েল। এই সব বাধ্য অশরীরীরা তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল বলে বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রের তরঙ্গ ছিল প্রসপেরোর নিয়ন্ত্রণে। একদিন তাঁর আদেশে এরা সমুদ্রের বুকে তুলল এক ভয়ানক ঝড়। সেই ঝড়ে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র তরঙ্গের সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে যুঝতে লাগল একটি মনোরম ও অতিকায় জাহাজ। রাক্ষুসে ঢেউগুলি যেন জাহাজটিকে গিলে খাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল। প্রসপেরো তাঁর মেয়েকে দেখালেন সেই দৃশ্য। বললেন, ওই জাহাজের মানুষেরাও তাঁদেরই মতো জ্যান্ত মানুষ। মিরান্দা বললে, “দোহাই তোমার বাবা, যদি নিজের জাদুবলে এই ঝড় তুলে থাকো, তবে এখনই একে সংবরণ করে নাও। দ্যাখো! জাহাজখানা যে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে বসেছে। আহা বেচারারা! আমার ক্ষমতা থাকলে সমুদ্রটাকেই রসাতলে পাঠাতুম। এমন সুন্দর জাহাজখানা আর এতগুলি মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হতে দিতুম না কিছুতেই।” প্রসপেরো বললেন, “উতলা হোস্ না, মা। আমার আদেশ আছে। ওদের কিচ্ছুটি হবে না। জাহাজের কারো গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগবে না। আর এই যা করছি, এ জানবি তোরই জন্য। তুই তো জানিস না যে তুই কে – কোথা থেকেই বা এসেছিস। আমি তোর বাপ; এই পোড়া গুহায় থাকি – এটুকু ছাড়া আমার সম্পর্কেই বা কতটুকু জানিস তুই? আচ্ছা, আগেকার দিনের কথা তোর কি কিছু মনে পড়ে, মা। বোধহয় পড়ে না, তাই না? কেমন করেই বা পড়বে? তুই যে তখনও তিন বছরেরও হোসনি।” মিরান্দা বললে, “নিশ্চয়ই মনে পড়ে, বাবা।” প্রসপেরো জিজ্ঞাসা করেন, “কেমন করে? আর কেউ কি কোনও দিন তোকে কিছু বলেছে? বল মা, আমায়, কি মনে পড়ে তোর!” মিরান্দা বললে, “কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। আচ্ছা বাবা, সেই সময় কি চার-পাঁচজন স্ত্রীলোক আমার পরিচর্যা করতেন?” প্রসপেরো বললেন, “করতেন বই-কি, আরও অনেকেই করতেন। কিন্তু সে সব কথা আজও কিভাবে মনে আছে তোর? আচ্ছা, এখানে আসার কথা কি কিছু মনে পড়ে?” মিরান্দা বললে, “না বাবা, আর কিছুই মনে পড়ে না আমার।” “বারো বছর আগের কথা,” প্রসপেরো বলতে থাকেন, “আমি তখন মিলানের ডিউক। আর তুই ছিলি রাজকন্যা – আমার একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। অ্যান্টোনিও নামে এক ভাইও ছিল আমার। পৃথিবীতে সে-ই ছিল আমার সবচেয়ে আস্থাভাজন লোক। লেখাপড়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল চিরকালের। অবসরযাপনই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। সেই জন্য রাজসভার যাবতীয় দায়দায়িত্ব তারই হাতে তুলে দিয়ে আমি সারাক্ষণ ডুবে থাকতুম বইয়ের জগতে। জীবন উৎসর্গ করেছিলুম হৃদয়কে মহত্তর করে তোলার কাজে। উপেক্ষা করেছিলুম যাবতীয় কর্তব্যকর্ম। এদিকে আমার বকলমা পেয়ে আমার ভাই নিজেকেই ডিউক ভাবতে শুরু করল। প্রজাদের মধ্যে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার একটা সুযোগ আমি তাকে দিয়েছিলাম। আর সেটাকেই হাতিয়ার করে সে লিপ্ত হল আমাকেই রাজ্যচ্যূত করার ষড়যন্ত্রে। মিথ্যাই সে আমার ভাই। ষড়যন্ত্র সফল করল সে কিনা আমারই চিরশত্রু নেপলস-রাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে!” মিরান্দা জিজ্ঞাসা করলে, “কিন্তু বাবা, তাঁরা সেই মুহুর্তেই আমাদের ধ্বংস করলেন না কেন?” প্রসপেরো উত্তর দিলেন, “আসলে মা, সে সাহস তাদের ছিল না। প্রজারা আমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসত। অ্যান্টোনিও আমাকে জোর করে একটা জাহাজে তোলে। তারপরে কূল থেকে কয়েক যোজন দূরে মাঝসমুদ্রে একটা ছোটো ডিঙিতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে জাহাজ নিয়ে চলে যায়। সেই ডিঙিতে না ছিল হাল, না ছিল কোনো পাল। ভেবেছিল, আমাদের ওভাবে ফেলে গেলেই বুঝি আমরা মারা পড়ব। কিন্তু গঞ্জালো নামে আমার এক অনুগত অমাত্য গোপনে সেই ডিঙিতে জল, খাবার, পোষাক আর আমার কিছু বই রেখে দিয়েছিল। এই বইগুলি আমার কাছে ছিল আমার রাজ্যের চেয়েও মূল্যবান।” মিরান্দা বললে, “ওহ্ বাবা, তবে আমার জন্য তোমাকে কত না কষ্ট সইতে হয়েছিল।” প্রসপেরো বললেন, “না সোনা, তুইই তো ছিলি আমার সেই ছোট্ট মানিক, যার মুখ চেয়ে বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। তোর মুখের নিষ্পাপ হাসি আমাকে সব প্রতিকূলতা জয় করার সাহস জোগাত। দ্বীপে এসে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রসদ ফুরালো। সেই থেকে আমার কাজ হল তোকে লেখাপড়া শেখানো। আর আমার শিক্ষকতায় আজ তুই রীতিমতো বিদূষী এক রাজকন্যা।”

মিরান্দা বললে, “ঈশ্বর তোমার ভাল করুন, বাবা। এখন বলো তো, এই ঝড় তুমি কেন তুললে?” প্রসপেরো বললেন, “শোন্ তবে, আমি ঠিক করেছি, আমার দুই পুরনো শত্রু, নেপলসের রাজা আর আমার সেই নিষ্ঠুর ভাইকে এই ঝড় তুলে এই দ্বীপে এনে ফেলব।” এই বলে মেয়েকে তাঁর জাদুছড়িটি দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। অশরীরী এরিয়েল হাজির হল প্রভুকে ঝড়ের বিবরণ দিতে। কেমন করে জাহাজের যাত্রীদের জাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সে, তার ফিরিস্তি শোনাতে। মিরান্দা এইসব অশরীরীদের দেখতে পেত না। তাই প্রসপেরোও চাইতেন না, তাঁকে এদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তাঁর মেয়ে ভাবুক, বাবা নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। সেই জন্য, এরিয়েল উপস্থিত হওয়া মাত্র, তিনি ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মেয়েকে। প্রসপেরো এরিয়েলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি সংবাদ, আমার সাহসী বেতাল? তোমার কাজ শেষ করেছো?” এরিয়েল তখন ঝড়ের এক চমৎকার বর্ণনা দিলে – কেমন করে জাহাজের নাবিকেরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল; যুবরাজ ফার্দিনান্দ জলে পড়ে গেলেন; বাপের চোখের সামনে তাঁকে গ্রাস করে নিল সমুদ্রের বিশাল ঢেউ – সে সব কথা বেশ গুছিয়ে বললে সে। তারপর এরিয়েল বললে, “সে অবশ্য এখন নিরাপদ। দ্বীপের এক কোণে দুই বাহুর উপর হাত রেখে বসে আছে। ভাবছে বাপটা বুঝি ডুবেই মোলো। তার নিজের কিন্তু একগাছি চুলেরও ক্ষতি হয়নি। এমনকি তার রাজপোষাকখানা জিভে জবজবে হয়ে গেলেও আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝলমল করছে এখন।” প্রসপেরো বললেন
0 votes
by
সমুদ্রের বুকে কোনও এক দ্বীপে বাস করতেন দুটি মানুষ – প্রসপেরো নামে এক বৃদ্ধ আর মিরান্দা নামে তাঁর পরমাসুন্দরী যুবতী কন্যা। মিরান্দা খুব অল্প বয়সে এই দ্বীপে এসেছিল। তাই বাবার মুখ ছাড়া আর কোনো মানুষের মুখ তার মনে পড়ত না। তাঁরা বাস করতেন একটা পাথুরে গুহায়। এই গুহায় বেশ কয়েকটি খুপরি ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল প্রসপেরোর পড়ার ঘর। এই ঘরেই তিনি রাখতেন তাঁর বইপত্তর। সে যুগে শিক্ষিত লোকমাত্রই জাদুবিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হতেন। প্রসপেরোও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাই তাঁর সংগ্রহের অধিকাংশ বইই ছিল জাদুবিদ্যা-সংক্রান্ত। জাদু জানতেন বলে তাঁর সুবিধাও হয়েছিল কত। ভাগ্যের বিড়ম্বনায় এই যে দ্বীপটিতে এসে তাঁকে বাসা বাঁধতে হয়েছিল, এই দ্বীপটি আগে ছিল সাইকোরাক্স নামে এক ডাইনির দখলে। সে সময়ে কিছু ভাল অশরীরীর দল তার অন্যায় আদেশগুলি পালন করতে না চাইলে ডাইনি তাদের গাছের কোটরে বন্দী করে রাখে। সাইকোরাক্স মারা যাওয়ার কিছুকাল পরে এই দ্বীপে এসে হাজির হন প্রসপেরো। তিনি নিজের জাদুবলে সেই সব অশরীরীদের মুক্তি দেন। কৃতজ্ঞতার বশে ওই অশরীরীর দলও তাঁর বশংবদে পরিণত হয়। এদের সর্দারের নাম ছিল এরিয়েল। প্রাণোচ্ছ্বল ছোট্ট প্রেত এরিয়েল। তার স্বভাব-চরিত্র মন্দ ছিল না। কিন্তু ক্যালিবান নামে কুৎসিত দৈত্যটাকে জ্বালাতন করতে বড়ো ভালবাসত সে। ক্যালিবান ছিল তার পুরনো দুশমন সাইকোরাক্সের ছেলে। দেখতে শুনতে মানুষের থেকে বনমানুষের সঙ্গেই তার সাদৃশ্য ছিল বেশি। এই হতভাগ্য প্রাণীটাকে জঙ্গলে কুড়িয়ে পান প্রসপেরো। অবশ্য তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন নি তিনি। বরং গুহায় নিয়ে এসে যত্ন করেন, কথা বলতে শেখান। কিন্তু মায়ের বদস্বভাব সে পেয়েছিল রক্তের সূত্রে। তাই কোনও ভাল কাজ তাকে শেখানো গেল না। অগত্যা তাকে রাখা হল ক্রীতদাসের মতো করে। কাঠ কুড়ানো আর সব কায়িক শ্রমের কাজগুলি তাকে দিয়ে করানো হতে লাগল। আর তাকে সব কাজ ঠিক ঠাক করিয়ে নেওয়ার দায়িত্বে প্রসপেরো নিয়োগ করলেন এরিয়েলকে। প্রসপেরো ছাড়া এরিয়েলকে দেখতে পেত না কেউই। এরিয়েলের সে ছিল মহাসুযোগ। কাজে ফাঁকি দিলেই চুপি চুপি এসে ক্যালিবানকে চিমটি কেটে যেত সে। কখনও পাঁকে ঠেলে ফেলে দিত; কখনও বনমানুষের মতো মুখখানি করে ভেংচি কাটত; আবার কখনও কাঁটাচুয়ো হয়ে পড়ে থাকত ক্যালিবানের যাতায়াতের পথে। খালি পায়ে কাঁটা বিঁধে যাওয়ার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত ক্যালিবান। প্রসপেরোর আজ্ঞা পালনে কোনও রকম গাফিলতি দেখলেই এই রকম নানা উপায়ে ক্যালিবানকে হয়রান করে ছাড়ত এরিয়েল। এই সব বাধ্য অশরীরীরা তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল বলে বায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রের তরঙ্গ ছিল প্রসপেরোর নিয়ন্ত্রণে। একদিন তাঁর আদেশে এরা সমুদ্রের বুকে তুলল এক ভয়ানক ঝড়। সেই ঝড়ে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র তরঙ্গের সঙ্গে প্রতি মুহুর্তে যুঝতে লাগল একটি মনোরম ও অতিকায় জাহাজ। রাক্ষুসে ঢেউগুলি যেন জাহাজটিকে গিলে খাওয়ার জন্য উদ্যত হয়ে উঠল। প্রসপেরো তাঁর মেয়েকে দেখালেন সেই দৃশ্য। বললেন, ওই জাহাজের মানুষেরাও তাঁদেরই মতো জ্যান্ত মানুষ। মিরান্দা বললে, “দোহাই তোমার বাবা, যদি নিজের জাদুবলে এই ঝড় তুলে থাকো, তবে এখনই একে সংবরণ করে নাও। দ্যাখো! জাহাজখানা যে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে বসেছে। আহা বেচারারা! আমার ক্ষমতা থাকলে সমুদ্রটাকেই রসাতলে পাঠাতুম। এমন সুন্দর জাহাজখানা আর এতগুলি মূল্যবান প্রাণ নষ্ট হতে দিতুম না কিছুতেই।” প্রসপেরো বললেন, “উতলা হোস্ না, মা। আমার আদেশ আছে। ওদের কিচ্ছুটি হবে না। জাহাজের কারো গায়ে আঁচড়টি পর্যন্ত লাগবে না। আর এই যা করছি, এ জানবি তোরই জন্য। তুই তো জানিস না যে তুই কে – কোথা থেকেই বা এসেছিস। আমি তোর বাপ; এই পোড়া গুহায় থাকি – এটুকু ছাড়া আমার সম্পর্কেই বা কতটুকু জানিস তুই? আচ্ছা, আগেকার দিনের কথা তোর কি কিছু মনে পড়ে, মা। বোধহয় পড়ে না, তাই না? কেমন করেই বা পড়বে? তুই যে তখনও তিন বছরেরও হোসনি।” মিরান্দা বললে, “নিশ্চয়ই মনে পড়ে, বাবা।” প্রসপেরো জিজ্ঞাসা করেন, “কেমন করে? আর কেউ কি কোনও দিন তোকে কিছু বলেছে? বল মা, আমায়, কি মনে পড়ে তোর!” মিরান্দা বললে, “কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। আচ্ছা বাবা, সেই সময় কি চার-পাঁচজন স্ত্রীলোক আমার পরিচর্যা করতেন?” প্রসপেরো বললেন, “করতেন বই-কি, আরও অনেকেই করতেন। কিন্তু সে সব কথা আজও কিভাবে মনে আছে তোর? আচ্ছা, এখানে আসার কথা কি কিছু মনে পড়ে?” মিরান্দা বললে, “না বাবা, আর কিছুই মনে পড়ে না আমার।” “বারো বছর আগের কথা,” প্রসপেরো বলতে থাকেন, “আমি তখন মিলানের ডিউক। আর তুই ছিলি রাজকন্যা – আমার একমাত্র উত্তরাধিকারিণী। অ্যান্টোনিও নামে এক ভাইও ছিল আমার। পৃথিবীতে সে-ই ছিল আমার সবচেয়ে আস্থাভাজন লোক। লেখাপড়ার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল চিরকালের। অবসরযাপনই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ। সেই জন্য রাজসভার যাবতীয় দায়দায়িত্ব তারই হাতে তুলে দিয়ে আমি সারাক্ষণ ডুবে থাকতুম বইয়ের জগতে। জীবন উৎসর্গ করেছিলুম হৃদয়কে মহত্তর করে তোলার কাজে। উপেক্ষা করেছিলুম যাবতীয় কর্তব্যকর্ম। এদিকে আমার বকলমা পেয়ে আমার ভাই নিজেকেই ডিউক ভাবতে শুরু করল। প্রজাদের মধ্যে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার একটা সুযোগ আমি তাকে দিয়েছিলাম। আর সেটাকেই হাতিয়ার করে সে লিপ্ত হল আমাকেই রাজ্যচ্যূত করার ষড়যন্ত্রে। মিথ্যাই সে আমার ভাই। ষড়যন্ত্র সফল করল সে কিনা আমারই চিরশত্রু নেপলস-রাজের সঙ্গে হাত মিলিয়ে!” মিরান্দা জিজ্ঞাসা করলে, “কিন্তু বাবা, তাঁরা সেই মুহুর্তেই আমাদের ধ্বংস করলেন না কেন?” প্রসপেরো উত্তর দিলেন, “আসলে মা, সে সাহস তাদের ছিল না। প্রজারা আমাকে মনেপ্রাণে ভালবাসত। অ্যান্টোনিও আমাকে জোর করে একটা জাহাজে তোলে। তারপরে কূল থেকে কয়েক যোজন দূরে মাঝসমুদ্রে একটা ছোটো ডিঙিতে আমাদের নামিয়ে দিয়ে জাহাজ নিয়ে চলে যায়। সেই ডিঙিতে না ছিল হাল, না ছিল কোনো পাল। ভেবেছিল, আমাদের ওভাবে ফেলে গেলেই বুঝি আমরা মারা পড়ব। কিন্তু গঞ্জালো নামে আমার এক অনুগত অমাত্য গোপনে সেই ডিঙিতে জল, খাবার, পোষাক আর আমার কিছু বই রেখে দিয়েছিল। এই বইগুলি আমার কাছে ছিল আমার রাজ্যের চেয়েও মূল্যবান।” মিরান্দা বললে, “ওহ্ বাবা, তবে আমার জন্য তোমাকে কত না কষ্ট সইতে হয়েছিল।” প্রসপেরো বললেন, “না সোনা, তুইই তো ছিলি আমার সেই ছোট্ট মানিক, যার মুখ চেয়ে বেঁচে থাকার একটা কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। তোর মুখের নিষ্পাপ হাসি আমাকে সব প্রতিকূলতা জয় করার সাহস জোগাত। দ্বীপে এসে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রসদ ফুরালো। সেই থেকে আমার কাজ হল তোকে লেখাপড়া শেখানো। আর আমার শিক্ষকতায় আজ তুই রীতিমতো বিদূষী এক রাজকন্যা।” মিরান্দা বললে, “ঈশ্বর তোমার ভাল করুন, বাবা। এখন বলো তো, এই ঝড় তুমি কেন তুললে?” প্রসপেরো বললেন, “শোন্ তবে, আমি ঠিক করেছি, আমার দুই পুরনো শত্রু, নেপলসের রাজা আর আমার সেই নিষ্ঠুর ভাইকে এই ঝড় তুলে এই দ্বীপে এনে ফেলব।” এই বলে মেয়েকে তাঁর জাদুছড়িটি দিয়ে আলতো করে স্পর্শ করতেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। অশরীরী এরিয়েল হাজির হল প্রভুকে ঝড়ের বিবরণ দিতে। কেমন করে জাহাজের যাত্রীদের জাহাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে সে, তার ফিরিস্তি শোনাতে। মিরান্দা এইসব অশরীরীদের দেখতে পেত না। তাই প্রসপেরোও চাইতেন না, তাঁকে এদের সঙ্গে কথা বলতে দেখে তাঁর মেয়ে ভাবুক, বাবা নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন। সেই জন্য, এরিয়েল উপস্থিত হওয়া মাত্র, তিনি ঘুম পাড়িয়ে দিলেন মেয়েকে। প্রসপেরো এরিয়েলকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি সংবাদ, আমার সাহসী বেতাল? তোমার কাজ শেষ করেছো?” এরিয়েল তখন ঝড়ের এক চমৎকার বর্ণনা দিলে – কেমন করে জাহাজের নাবিকেরা ভয়ে কুঁকড়ে গেল; যুবরাজ ফার্দিনান্দ জলে পড়ে গেলেন; বাপের চোখের সামনে তাঁকে গ্রাস করে নিল সমুদ্রের বিশাল ঢেউ – সে সব কথা বেশ গুছিয়ে বললে সে। তারপর এরিয়েল বললে, “সে অবশ্য এখন নিরাপদ। দ্বীপের এক কোণে দুই বাহুর উপর হাত রেখে বসে আছে। ভাবছে বাপটা বুঝি ডুবেই মোলো। তার নিজের কিন্তু একগাছি চুলেরও ক্ষতি হয়নি। এমনকি তার রাজপোষাকখানা জিভে জবজবে হয়ে গেলেও আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝলমল করছে এখন।

Related questions

উত্তর সন্ধানী! বেস্ট বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর ওয়েবসাইট। প্রশ্ন করুন, উত্তর নিন, সমস্যা সমাধান করুন ।
উত্তর সন্ধানী কি?
উত্তর সন্ধানী বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর এর ওয়েবসাইট।
গোপন প্রশ্ন ও উত্তর। ডিজিটাল শিক্ষায় প্রশ্নের উত্তরের সেরা ওয়েবসাইট।
...