সময়ের মূল্য
ভূমিকা : অন্তহীন যাত্রাপথে নিরন্তর বয়ে চলেছে সময়। সে চলার বিরতি নেই, নেই পিছুটান। মহাকালের সেই নিরবধি প্রবাহে ক্ষণবন্দী মানুষের জীবন। তাতে প্রত্যেক মানুষের জীবন সময়ের শৃঙ্খলে বাঁধা। সময়ের মহাসমুদ্রে মানুষ মাত্রই জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত বেয়ে যায় তার ছোট্ট জীবনের ভেলা। অনন্ত প্রবাহিত সময়ধারা থেকে যে খণ্ড সময়টুকু মানুষ তার জীবন রচনার জন্যে পায় তা এত দুর্লভ, এত মূল্যবান যে মানুষকে চিরকাল হাহাকার করতে হয়- ‘নাই যে সময়, নাই নাই’। জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে সে হাহাকার করে- ‘জীবন এত ছোট কেন?’ তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মানুষের জীবনে মহামূল্যবান।
মানবজীবনে সময়ের মূল্য : অনন্ত মহাকালের বুকে মানুষ তার জীবনে পায় সামান্য কিছু দুর্লভ সময়। এ সময়টুকুও অনন্ত বহমানতায় হারিয়ে যায়। কবি হেমচন্দ্রের ভাষায়-
দিন যায় ক্ষণ যায় সময় কাহারো নয়
বেগে ধায়, নাহি রহে স্থির।
তাই জীবনের মূল্যবান প্রতিটি মুহূর্ত ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারলেই জীবন সফল হয়, সুন্দর হয়, সার্থক হয়, জীবনের মূল্যবান সময় হাতে পেয়েও মানুষ তাকে কাজে লাগায় না। সময়কে অবহেলা করে, আলস্য সময়ের অপচয় করে। সময়কে চোখে দেখা যায় না বলে মানুষ ভুল করে। অলস হয়ে, কর্মবিমুখ হয়ে বসে থাকে বলে তাদের জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট হয়। ফলে জীবনে তাদের ব্যর্থতার জ্বালা সইতে হয়। কারণ, যে সময় চলে যায় তা আর কখনো ফিরে আসে না। তাই মানুষের জীবনে কর্মের ও সৃজনের সফলতা অনতে হলে সময়ের মূল্য অনুধাবন করা দরকার।
বাঙালির সময়জ্ঞান : দুঃখের বিষয় বাঙালির জীবনে সময়-সচেতনতা খুবই কম। এর মূলে রয়েছে বাঙালির প্রাচীন জীবনযাত্রা থেকে প্রাপ্ত অভ্যাস। দীর্ঘকাল ধরে বাঙালির সমাজজীবনের কাঠামো ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। সেখানে জীবনে জটিলতা ছিল কম। অল্প আয়াসে সোনার ফসলে মাঠ ভরে যেত বলে জীবন সংগ্রামের গতি ছিল মন্থর। প্রচুর অবসর মিলত বলে সেকালে বাঙালির জীবনে ছিল বারো মাসে তের পার্বণের আনন্দ। বাইরের জগৎ কোথায় চলেছে সেদিকে বাঙালি খুব একটা ফিরে তাকায় নি। কিন্তু বাঙালির সুখবিভোর অলস-মন্থরতা ভরা জীবনে প্রবল অভিঘাত লাগে এদেশে ইংরেজ আগমনের পর পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে দেখা গেল, পৃথিবী যেমন এগিয়ে গেছে তেমনি তাদের সময়-সচেতনতার তুলনায় বাঙালির সময়-সচেতনতা রয়েছে অনেক পিছিয়ে। এরপর বাঙালির সময়-সচেতন হতে চেষ্টা করছে। কিন্তু অলস অভ্যাসের জের এখনো চলছে। বাঙালির সময়জ্ঞান সম্পর্কে যে ঠাট্টা-বিদ্রুপ চলে সে অপবাদ এখনও আমরা মোচন করতে পারি নি।
সময় সচেতনতার গুরুত্ব : জীবনের সার্থকতার জন্যে সময়নিষ্ঠা একটা গরুত্বপূর্ণ শর্ত। Time and tide wait for none- এই সুভাষিতটি মনে রাখলে আমরা বুঝতে পারি আমাদের জীবনে প্রতিটি মুহূর্ত কত মূল্যবান। স্বাস্থ্য হারালে তা আবার ফিরে পাওয়া যায়, হারানো সম্পদ হয়তো পুনরুদ্ধার সম্ভব। কিন্তু হারানো, উপেক্ষিত, অপব্যয়িত সময়কে জীবনে কিছুতেই আর ফিরে পাওয়া যায় না। তাই জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সুপরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানো দরকার। সময়নিষ্ঠ ইংরেজদের আরোও একটি সুভাষিত রয়েছে : Time is money. কথাটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। সময়জ্ঞান আক্ষরিক অর্থে সবসময় হয়তো অর্থপ্রাপ্তি ঘটায় না। কিছু সময় মানব জীবনে নিঃসন্দেহে মূল্যবান সম্পদ। সময়ের আক্ষরিক সদ্ব্যবহার করে মানুষ অর্থ, সম্পদ, জ্ঞান, সৃজনকর্ম ইত্যাদি ফুল-ফল-ফসলে জীবনকে ভরিয়ে দিতে পারে। এতে জীবন হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ, সার্থক।
ছাত্রজীবন ও সময়নিষ্ঠা : ছাত্রজীবন হচ্ছে মানুষের ভবিষ্যৎ ফসল জীবন গঠনের প্রস্তুতিপর্ব। সময়ানুবর্তিতার মাধ্যমে প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগানোর অভ্যাগ গড়ে তোলার প্রকৃষ্ট সময় ছাত্রজীবন। ছাত্রজীবনে লেখাপড়া, খেলাধুলা, বিনোদন ও বিশ্রামের জন্যে সুষ্ঠু সময়- পরিকল্পনা করা দরকার। শ্রমকুণ্ঠ, সময়-অসচেতন, আলস্যপ্রিয় ছাত্র কেবল যে লেখাপড়ায় পিছিয়ে যায় তা নয়, বৃহত্তর জীবনের পদে পদে তাকে ফেলতে হয় ব্যর্থতার দীর্ঘস্বাস। তাই অন্যান্য শিক্ষার পাশাপাশি সময়নিষ্ঠ হওয়ার শিক্ষাও ছাত্রজীবনে অর্জন করতে হয়। এ সময় সময়ানুবর্তিতা অভ্যাসে পরিণত হলে তার ভবিষ্যৎজীবনেও তা কার্যকর ও ফলপ্রসূ হয়ে উঠবে।
মনীষীদের জীবনে সময়নিষ্ঠার তাৎপর্য : মানব-ইতিহাসে যাঁরা বরণীয় স্মরণীয় হয়ে আছেন তাঁদের জীবন সময়-সচেতনতার তাৎপর্যে ভাস্বর। খণ্ডকালের জীবনে সময়ের শাসনকে স্বীকার করে নিয়েই তাঁরা জীবনকে দিয়েছেন পূর্ণতা, কালের বাঁধনকে অতিক্রম করে অর্জন করেছেন কালান্তরের অমরত্ব। বিশ্ববনেণ্য কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকরা সীমিত জীবনেই ফলিয়ে গেছেন চিরায়ত সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। নিবেদিতপ্রাণ মহৎ দার্শনিক, বিজ্ঞানী অতন্দ্র সাধনায় জগৎকে সমৃদ্ধ করেছেন নব নব আবিষ্কারের অজস্র সম্পদে। মহৎ ধর্মসাধক, দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, রাষ্ট্রনায়কদের সীমিত খণ্ড-পরিসর জীবনের মহৎ অবদান ও ভূমিকায় অর্জিত হয়েছে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার নব নব অগ্রগতি। এসব মহামানব জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়েই পেয়েছেন সাফল্যের স্বর্ণমুকুট। মর জীবনে অর্জন করেছেন অমরত্বের মহিমা। তাঁদের জীবন থেকে শিক্ষা নিলে আমরা সময়ের মূল্য বুঝতে পারি। হতে পারি সময়ানুবর্তী ও সময়-সচেতন।
উপসংহার : আধুনিক কালে জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে জটিল ও বহুমুখী। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্র অকল্পনীয়ভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। জীবন সংগ্রামে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। পারিবারিক, শিক্ষাগত, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক জীবনে নিত্য নতুন পরিস্থিতিতে অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হয়। বিনোদনেও প্রচুর সময় দিতে হয়। তাই সময়ের ব্যবহার হওয়া চাই অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও ফলপ্রসূ। তাহলেই স্বপ্নিল জীবনে আসবে সার্থকতা। সময়কে কাজে লাগানোর গুরুত্বটি কেবল ব্যক্তিগত জীবনের ব্যাপার নয়, জাতীয় জীবনেও তার গুরুত্ব অপরিসীম। একশ শতকের পৃথিবী আজ বিস্ময়কর গণিতে আগুয়ান। সুপরিকল্পিত সময়নিষ্ঠ ছাড়া আমাদের দেশ ও জাতি কি পশ্চাৎপদ জিবনকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে? এক্ষেত্রে সফল হতে হলে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে চাই সময়নিষ্ঠার ছাড়পত্র।