সোনালি আঁশ পাট ভূমিকা : পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। কারণ বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল হলো পাট। পাটের আঁশ যেমন দেখতে সোনালি চুলের মতো তেমনি এর মূল্যও সোনার মতো দামি। তাই পাটের অপর নাম স্বর্ণসূত্র। পরিচয় : পাট এক রকমের তৃণজাতীয় উদ্ভিদ। পাটগাছ পাঁচ থেকে দশ হাত লম্বা হয় এবং আধ থেকে এক ইঞ্চি পরিমাণ মোটা হয়। পাটগাছ সোজা ও লম্বা হয়। এ গাছের কোনো ডালপালা থাকে না। মাথার আগায় থাকে একগুচ্ছ সবুজ পাতা। পাটগাছের রং সবুজ হলেও পাটের রং সাদা ও লালছে ধরনের হয়। প্রকারভেদ : আমাদের দেশে সাধারণত দুপ্রকার পাট উৎপন্ন হয়। এক প্রকার পাটের পাতা ও গাছের আবরণ অত্যন্ত তেতো। কোনো কোনো পাটগাছের পাতা একটু মিষ্টি ধরনের হয়। এ পাতা শাক হিসাবে খাওয়া হয়। পাট চাষের সময়, পদ্ধতি, উৎপত্তি-স্থান : উষ্ণ জলবায়ু আর প্রচুর বৃষ্টিপাত পাটচাষের পক্ষে উপযোগী। যেসব জমি প্রতিবছর পানিতে ডুবে যায় এবং যেসব জমিতে প্রচুর পলিমাটি পড়ে সেসব দোআঁশলা মাটিতে পাট জন্মে প্রচুর। লাল রঙের বগি পাট উঁচু জমিতে ভালো জন্মে। বাংলাদেশের জলবায়ু পাটচাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। পাটের জমিতে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে জৈবসার প্রয়োগ করলে জমির উর্বরাশক্তি বাড়ে। আমাদের দেশে চৈত্র-বৈশাখ মাসে পাটের জমি ভালো করে চাষ দিয়ে বীজ বুনতে হয়। সময়মতো বৃষ্টি না হলে পাট নষ্ট হয়ে যায়। পাটের চারা-গাছগুলো যখন বড় হতে থাকে তখন ঘনঘন নিড়ানি দিয়ে গাছের আগাছা পরিষ্কার করতে হয়। ঘনঘন জন্মানো গাছ থেকে কিছু চারাগাছ তুলে নিলে ফলন ভালো হয়। পাট তোলার সময় হলো শ্রাবণ-ভাদ্র মাস। এসময় পাট কেটে ছোট ছোট আঁটি করে বেঁধে রাখতে হয়। কুড়ি পঁচিশ দিন আঁটিগুলি পানিতে ডুবিয়ে রাখলে পাতাগুলো পানিতে ঝরে যায় এবং পাটের বাকলাগুলো নরম ও আলগা হয়ে ওঠে। খড়ি থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাকলাগুলো পানিতে ভালো করে ধুয়ে শুকানোর পরই পাওয়া যায় পাট। পৃথিবীতে বাংলাদেশই হলো সর্বাধিক পাট উৎপাদনকারী দেশ। সারা পৃথিবীর প্রায় সত্তর ভাগ পাট এদেশেই জন্মে। তা ছাড়া ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও মায়ানমার প্রভৃতি দেশেও পাট উৎপন্ন হয়। প্রয়োজনীয়তা : আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পাটের নানাবিধ প্রয়োজন রয়েছে। পাট থেকে কাপড়, কার্পেট, চট, থলে, বস্তা ও দড়ি প্রভৃতি তৈরি হয়। আমাদের দেশে পাট থেকে ’জুটন’ নামে এ শ্রেণির ভারি মূল্যবান কাপড় ও পাটখড়ি দিয়ে ’পারটেকস’ তৈরি হচ্ছে। তা ছাড়া পাটের আঁশ দিয়ে উন্নত ও আন্তর্জাতিক মানের নানারকম কুটিরশিল্প সামগ্রী এখন প্রচুর পরিমাণে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। পাটখড়ি দিয়ে কাগজও তৈরি হয়। গ্রামে পাটখড়ি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং অনেক দরিদ্র চাষি পাটখড়ি দিয়ে বাড়ির বেড়া তৈরি করে থাকে। পাটগাছের কচি পাতা শাক হিসেবে খায়। পাটকল-পরিস্তিতি : আমাদের দেশে এক সময় ছোট বড় প্রায় ৩০টির বেশি পাটকল ছিল। এক সময় আমাদের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার শতকরা আশি ভাগ আসত পাট রপ্তানি থেকে। তবে সে-যুগ এখন আর নেই। আমাদের দেশে যেসব পাটকল রয়েছে তাতে কয়েক লক্ষ লোক কাজ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে। পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল ছিল আমাদের দেশের এক সময়কার গৌরব। কিন্তু অতিরিক্ত লোকসানের কারণে সরকার ২০০২ সালে এ পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বেকার হয়ে পড়েছে প্রায় তিরিশ হাজার লোক। বাংলাদেশে পাট-পরিস্থিতি : বর্তমানে বাংলাদেশে পাটের চাষ ও পাটের বাজারজাতকরণ এক চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও অন্য পাটকলগুলোর অব্যবস্থাপনার কারণে পাটচাষিরা পাট বিক্রির উন্মুক্ত বাজার আর পাচ্ছে না। উপসংহার : আমাদের দেশে পাট চাষিরা যাতে পাটের ন্যায্যমূল্য পায় সেদিকে সরকারকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, পাটের বহুমুখী ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশ্বের বাজারে যেন আমাদের পাটের চাহিদা আরও বাড়ে সে জন্য বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ নিতে হবে।