সাহিত্য পাঠের প্রয়োজনীয়তা ভূমিকা : ‘বস্তুত বহিঃপ্রকৃতি এবং মানবচরিত্র মানুষের হৃদয়ের মধ্যে অনুক্ষণ যে আকার ধারণ করিতেছে, যে সংগীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছে, ভাষা রচিত সেই চিত্র এবং গানই সাহিত্য।’ -রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্য’ শব্দটি এসেছে ‘সহিত’ থেকে। সাহিত্য বলতে বোঝায় সঙ্গ, সংসর্গ, সাহর্চয বা মিলনকে। বিশদার্থে মানুষের ব্যক্তিগত ও জাতীয় চিন্তা লিখিত ভাষায় ব্যক্ত হলে সাহিত্যের সৃষ্টি করে। মানুষ তার মনের ভাবকে প্রকাশ করবে বলে অথবা অপরকে তা জানাবে বলে সাহিত্যের আশ্রয় নেয়। ‘অপর’ বলতে সমাজেরই মানুষ, যারা আমাদের সামনে-দূরে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র বাস করছে। আবার যেহেতু ব্যক্তি-মানুষও সমাজেরই অঙ্গ সে কারণে যিনি সাহিত্য সৃষ্টি করেন, তিনি সমাজের একজন হিসেবে সমাজের জন্যেই তা করে থাকেন। সৃষ্টিতে তাঁর ব্যক্তিগত আনন্দ, এ কথা মেনে নিয়েও বলা যায়, দশজনকে সেই আনন্দের স্বাদ দেয়াতেই তাঁর মনে বিশেষ তৃপ্তি, কর্মের প্রকৃত সার্থকতা। সাহিত্য রূপের মধ্যে অরূপকে ব্যক্ত করার চেষ্টা, সীমাকে অসীমের মধ্যে বিস্তৃত করার আকুতি, ভাষার মধ্যে ভাষাতীতকে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাকুলতা। সাহিত্যস্রষ্টা যুগে যুগে পাঠকের হাতে তুলে দেন সৃষ্টির অমৃত পাত্র। পাঠক নির্বিকল্প রসানন্দে হন আবিষ্ট। সহৃদয় পাঠকের রসাস্বাদনেই সাহিত্য-সৃষ্টির সার্থকতা। সাহিত্যে আনন্দের উপলব্ধি : ‘যেখানেই আমাদের আছে সত্যের উপলব্ধি, সেখানেই আমরা আনন্দকে দেখিতে পাই। সত্যের অসম্পূর্ণ উপলব্ধিই আনন্দের অভাব।’ সাহিত্যের মধ্যে শাশ্বত সত্যেরই অনুভব। যুগ-যুগান্তর ধরে বহির্বিশ্বের সর্বত্র যে নিত্য নতুন রূপের অহরহ লীলা চলছে, কবি-সাহিত্যিকের দল ধ্যানমগ্ন চিত্তে তাকেই ‘হৃদয়বৃত্তির নানা রঙে নানা ছাঁচে’ নানারকম করে সৃষ্টি করে চলেছেন। সেই অপরূপকে রূপময় করে তোলার জন্য তাঁরা অলংকারের রূপকের ছন্দের আভাস-ইঙ্গিতের আশ্রয় গ্রহণ করেন। কিন্তু সাহিত্যের অনির্বচনীয়তা ‘অলংকারকে অতিক্রম করিয়া ওঠে, তাহা অলংকারের দ্বারা আচ্ছন্ন হয় না।’ সাহিত্য রূপের মধ্যে রূপাতীতের আনন্দ-অনুভব। আনন্দই সাহিত্যের আদি মধ্য অন্ত। ‘আনন্দই তাহার উদ্দেশ্য।’ সাহিত্যপাঠে সেই আনন্দেরই স্পর্শলাভ ঘটে। কেননা, ‘ভগবানের আনন্দসৃষ্টি আপনার মধ্য হইতে আপনি উৎসারিত; মানবহৃদয়ের আনন্দসৃষ্টি তাহারই প্রতিধ্বনি। এই জগৎসৃষ্টির আনন্দ-গীতের ঝংকার আমাদের হৃদয়বীণাতন্ত্রীকে অহরহ স্পন্দিত করিতেছে; সেই-যে মানসসংগীত, ভগবানের সৃষ্টির প্রতিঘাত আমাদের অন্তরের মধ্যে সেই-যে সৃষ্টির আবেগ, সাহিত্য তাহারই বিকাশ।’ সাহিত্যপাঠ আত্মোপলব্ধির উপায় : যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিকেরা জগৎজীবনের রহস্য-আবরণ উন্মোচন করে যে অনির্বচনীয় আনন্দ, রসানুভূতি আস্বাদন করেন সাহিত্য তারই প্রকাশ। তখন আর ‘সাহিত্য ব্যক্তি বিশেষের নহে, তাহা রচয়িতার নহে, তাহা দৈববাণী।’ সাহিত্যপাঠে পাঠকও সেই দৈববাণীই উপলব্ধি করে। অনুভব করে অধরা মাধুর্যের আনন্দ-স্পর্শ। ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনা, শোকসন্তাপ, প্রাত্যহিক সংসার-মালিন্য এক চিরকালীন সত্যস্বরূপের সান্নিধ্যে এসে এক অনন্ত প্রবাহের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। হৃদয়পাত্র ভরে ওঠে এক অনাবিল রস-ধারায়। সত্যের যথার্থ উপলব্ধিমাত্রই আনন্দ, তাহাই চরম সৌন্দর্য। সাহিত্যপাঠ সেই গভীর আত্মোপলব্ধিরই উপায়মাত্র। মহৎ সাহিত্য তাই দেশে-দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে উত্তীর্ণ। সেই কালজয়ী সাহিত্যই যুগে যুগে পাঠক মনে দিয়েছে অপার তৃপ্তি। ছিন্ন করেছে সামাজিক তুচ্ছতার ক্ষুদ্রতার বন্ধন, মহৎ উপলব্ধিতে জীবন হয়েছে সার্থক। ক্ষণকালের জীবন মিশে গেছে অনন্ত জীবনে। সাহিত্যে সমাজচিত্রের রূপায়ণ : সমাজ চলমান। মানুষের ধারাও থেমে নেই। এরই মধ্যে কত সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার মালা গাঁথা। কত বিরহ-মিলনের স্বগত প্রলাপ। কত পরাভূত জীবনের দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার, কত আশা আর আশা-ভঙ্গের করুণ কথা। মনের নিভৃতে সঞ্চিত কত আকাঙ্ক্ষার ব্যর্থ পরিণতি। মানুষকে নিয়েই সমাজ। সমাজ মানুষেরই জন্য। তাই দেশকালের কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা, জীবনের চড়াই-উৎরাই-এর কত অভিজ্ঞতা সাহিত্যের উপজীব্য বিষয় হয়েছে। সমাজ বদলায়। বদলায় তার রীতি-নীতি, আদব-কায়দা। সাহিত্যের বিষয়ে, আঙ্গিকেও তাই যুগে যুগে ঘটে রূপান্তর। তবু সাহিত্যের মধ্যে বিধৃত হয় মানুষের চিরকালীন পরিচয়। কালপ্রবাহে ব্যক্তি বিলীন হয়ে যায় কিন্তু সাহিত্যের কুশিলবরা বেঁচে থাকে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সব একাকার হয়ে যায়। বিশ্বের বরণীয় কবি সাহিত্যিকরা সমাজকে উপেক্ষা করতে পারেন নি। কখনো তাঁরা সমাজকে দেখেছেন নিরপেক্ষভাবে। কখনো সমাজ সম্পর্কে তাঁদের ক্ষোভ, অভিযোগ বিভিন্ন চরিত্রের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সমাজ বিষয়ে কেউ উদাসীন নন। সাহিত্য ও সভ্যতা : বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার সভ্যতাকে করেছে গতিমুখর, করেছে কর্মচঞ্চল। ভোগবিলাসের উপকরণ প্রাচুর্যের হাতছানিতে মানুষ আজ দিশেহারা। সহস্রমুখী বাসনার উদ্দম উচ্ছাস। কেবলই আবেগ উত্তেজনা, জটিল কর্তব্য শৃঙ্খল। বাণিজ্যের জুয়া খেলা। কেবলই সম্পদ আহরণ ও আবিষ্কারের মত্ততা। আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর সভ্যতার কর্মব্যস্ত পরিবেশে তাই সাহিত্যপাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে। সংশয় জেগেছে আমাদের ব্যবহারিক জীবনে এর উপযোগিতা নিয়ে। কেননা, সাহিত্য সৃষ্টির জন্য চাই অবকাশ। ‘ইহার জন্য অনেকখানি আকাশ, অনেকখানি সূর্যালোক, অনেকখানি শ্যামল ভূমির আবশ্যক।’ কিন্তু কাজের তাড়ার মানুষের সেই অবসর গেছে হারিয়ে। সভ্যতার এই সহস্র বন্ধনের মধ্যেও সাহিত্য হয়েছে সৃষ্টিমুখর। ধ্রুপদী সাহিত্যের আবেদন আজও অম্লান। আজও জগতের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক মানুষের অকৃত্রিম সুহৃদ। সাহিত্যই মানবসভ্যতার পালয়িত্রী জননী; ‘কেবল পাকা রাস্তাই যে মানুষের পক্ষে আবশ্যক তাহা নয়, শ্যামল ক্ষেত্র তাহা অপেক্ষা অধিক আবশ্যক।’ সাহিত্যপাঠ ভিন্ন সেই সভ্যতার প্রকৃতি, স্বরূপ নির্ণয় অসম্ভব। মনের স্বাস্থ্যবিধানে সাহিত্যপাঠ : দেহ ও মন নিয়েই মানুষ। দেহের পুষ্টির জন্যে যেমন খাদ্যের প্রয়োজন, প্রয়োজন সেই খাদ্য সংগ্রহের নিরন্তর চেষ্টা ও উদ্যম, তেমনই মনের স্বাস্থ্যের জন্যে অপরিহার্য মানসিক খাদ্যের। মনের খাদ্য আহরণের জন্যে রূপ-রসের হাটে তার নৃত্য আনাগোনা। মনের ঐশ্বর্যেরই খনি। মনের খাদ্য তাই প্রত্যক্ষগোচর নয়, তা অনুভবের বিষয়। সেই অনুভবের সৌন্দর্য সমগ্র জীবনেই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। ‘সাহিত্যের প্রভাবে আমরা হৃদয়ের দ্বারা হৃদয়ের যোগ অনুভব করি, হৃদয়ের প্রবাহ রক্ষা হয়, হৃদয়ের সহিত হৃদয় খেলাইতে থাকে হৃদয়ের জীবন ও স্বাস্থ্য সঞ্চার হয়।’ সাহিত্য যুগে যুগে মানুষকে দিয়েছে মহৎ জীবনের দীক্ষা। মানবজীবনের মহিমাকে করেছে গৌরবদীপ্ত। অধর্ম অন্যায়কে আশ্রয় করে যে অতিদর্পীরও পরাভব অনিবার্য, শক্তি-দম্ভস্ফীত মানুষও যে নেপথ্য-শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন, অমিত আকাঙ্ক্ষার অসংযমে, হিংসার অতিমাত্রিক প্রকাশে, দ্বিধাদ্বন্দ্বের দোলাচল মনোভাবে জীবন যেখানে সর্বনাশ-কবলিত, ভোগ নয় ত্যাগ, মোহ নয় কল্যাণ-এই চিরন্তন সত্যই সাহিত্যে নিত্য উদ্ভাসিত। সাহিত্যপাঠই আমাদের মনের সঙ্কীর্ণতা দূর করে। উদ্বুদ্ধ করে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধে। ‘সাহিত্যের প্রভাবে হৃদয়ে হৃদয়ে শীতাতপ সঞ্চারিত হয়, বায়ু প্রবাহিত হয়, ঋতুচক্র ফিরে, গন্ধ, গান ও রূপের হাট বসিয়া যায়।’ সাহিত্যে অমরত্বের প্রার্থনা : ‘প্রকৃত সাহিত্যে আমরা আমাদের কল্পনাকে, আমাদের সুখ-দুঃখকে, শুদ্ধ বর্তমান কাল নহে, চিরন্তন কালের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করিতে চাই।’ কবি-সাহিত্যকরাই সভ্যতার অগ্রদূত। তাঁদেরই ধ্যান দৃষ্টিতে আগামী দিন প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। তাঁরা চিরন্তরের অমৃত-সন্ধানী। তাঁরাই অনাগত কালের ভাষ্যকার। তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যেই আমরা ভবিষ্যতের একটা রূপরেখার পরিচয় পাই। ‘একমাত্র সাহিত্যই যাহা আমাদিগকে জানাইতে চায় তাহা সম্পূর্ণরূপে জানায়।’ সাহিত্যের মধ্যেই, ‘আমি যাহা ভাবিয়াছি, যাহা বোধ করিয়াছি, তাহা চিরদিন মানুষের ভাবনা, মানুষের বুদ্ধি আশ্রয় করিয়া সজীব সংসারের মাঝখানে বাঁচিয়া থাকিব।’ সাহিত্যপাঠের মধ্যে দিয়ে আমরা সেই শাশ্বত অমরতার প্রার্থনা শুনি। আমরাও লাভ করি চিরন্তনত্বের স্পর্শ। পাই মহৎ চিন্তার নিবিড় সান্নিধ্য। উপসংহার : সাহিত্য আমাদের প্রাত্যহিক ব্যবহারিক জীবনের কোনো সমস্যার সমাধান নয়, আমাদের আটপৌরে জীবন- যাপনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা নগণ্য, তবু সাহিত্যের কাছেই আমাদের জন্ম-জন্মান্তের ঋণ। সাহিত্যই দেশে দেশে কালে কালে মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে দৃঢ় করে। সাহিত্যপাঠেই মনের কলুষ কালিমার ঘটে অবলুপ্তি। সাহিত্যই হিংস্র সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তিকে পরাভব করার দুর্জয় শক্তি জোগায়। সুন্দরের আরাধনায় মানুষ হয় মগ্ন। সাহিত্যই মানুষের কাছে অভয়মন্ত্র। সাহিত্যই মানের রুদ্ধ দুয়ার খুলে দেয়। মানুষকে কল্যাণব্রতে করে অনুপ্রাণিত। চিন্তার স্বচ্ছতা, প্রকাশের ঋজুতা সাহিত্য-পাঠেই সম্ভব। মানবজীবনে সাহিত্যপাঠের মূল্য তাই গভীর ও ব্যাপক। সাহিত্য-পাঠই সন্তাপে সান্ত্বনা, দুঃখে দুঃখজয়ের ব্রত, পরাজয়ে সহিষ্ণুতায় দীক্ষা। সাহিত্য শুভ বুদ্ধি জাগরণের মন্ত্র। গোপনে গোপনে, অলক্ষ্যে, অপ্রত্যক্ষে সেইধারা বয়ে চলে যুগ থেকে যুগান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে, ক্ষণকাল থেকে চিরকালের দিকে