সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভূমিকা : সৃষ্টিতত্ত্বে মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য নেই। আকৃতি-প্রকৃতি, সুখ-দুঃখ, ক্ষুধা-তৃষ্ণা, আহার-বিশ্রামের অনুভূতিতে সব মানুষ অভিন্ন। পৃথিবীর যেকোনো দেশের অধিবাসী হোক, মানুষের একমাত্র পরিচয় হলো সে মানুষ। সবার উপরে মানুষ সত্য- এটিই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মূলমন্ত্র। মানুষ এই সত্যকে ভুলে কৃত্রিম জাতি ও ঘৃণ্য জাতিভেদ তৈরি করেছে। ভেদবুদ্ধিতে প্রণোদিত হয়ে গড়ে তুলেছে বিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীর। কিন্তু সেই অসংখ্য বর্ণ-বৈচিত্র্যের মাঝে অতীতের মতো আজও মানুষ বহন করে চলছে এক ও অভিন্ন রক্ত এবং মানবঐতিহ্য। সাম্প্রদায়িকতা : মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা না করে ধর্ম, বর্ণ ও জাতি-গোত্র ইত্যাদি দিয়ে পার্থক্য করে দেখাই সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে- এক গোত্র, বর্ণ ও জাতির ওপর অন্য গোত্র, বর্ন ও জাতির আধিপত্যের লড়াই। সমাজবদ্ধ মানুষ নানা ধর্ম-সম্প্রদায়ে বিভক্ত। কিন্তু ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা এক নয়। পৃথিবীর সকল ধর্মের মূলকথা প্রেম, মৈত্রী, শান্তি ও সম্প্রীতি। এই শিক্ষা থেকে সরে এসে এক সম্প্রদায়ের প্রতি অন্য সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ বা আক্রোশই সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন প্রকাশ মানুষকে পশুতে পরিণত করতে পারে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শুধু সাম্প্রদায়িকতার কারণে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। দারুণভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবতা। সাম্প্রদায়িকতা তাই মানুষের যুগ-যুগান্তের অভিশাপ। সাম্প্রদায়িকতার সূচনা : পৃথিবীতে মানুষের আগমনের সূচনাপর্বে কোনো ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোত্রভেদ ছিল না। ফলে তখন তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটেনি। পরবর্তীতে মানুষ যখন সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল, তখন থেকে আত্মস্বার্থের কারণে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, জাতি, বর্ণভেদ, গোত্র ইত্যাদির প্রকাশ ঘটল। জাতিবিদ্বেষের তীব্র বিষ ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে, দেশে দেশে। বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এই জাত্যভিমান ছিল সবচেয়ে বেশি। উপমহাদেশে মুঘল আমলে দোল খেলাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকরা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিবাদ বাধানোর চেষ্টা করেছিল। নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য এবং হিন্দু-মুসলমান যাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পরবর্তীতে আন্দোলন করতে না পারে। ১৯২২ থেকে ১৯২৭ এই কয়েক বছরে একশটিরও বেশি দাঙ্গা ঘটেছিল। ১৯৩০ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছে। পরবর্তীতে ভারতে ছোট-বড় অনেক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। সাম্প্রদায়িকতার কুফল : সাম্প্রদায়িকতা দেয়নি কিছুই, করেছে অনেক ক্ষতি। সাম্প্রদায়িকতা মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় উন্নতির অন্তরায়। মানুষের সভ্য, সুস্থ ও শান্তিময় জীবনকে নষ্ট করে। মানুষকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। হীন সাম্প্রদায়িকতার মূল নিহিত আছে বিভিন্ন ধর্মের গোঁড়ামি ও অন্ধবিশ্বাসের ওপর। অথচ কোনো ধর্মই ভেদবুদ্ধিকে সমর্থন করে না। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরিকেও ঘৃণা করে। কারণ ধর্মের ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি নেই (আল কুরআন)। ধর্ম ব্যবসায়ীদের কারণেই দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে সীমাহীন ভেদবুদ্ধি, বিভেদ ও হিংসার অগ্নিদহন। জাতি-বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ থেকেও পৃথিবীর বহু জাতি, রাষ্ট্র যুদ্ধ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত, পাকিস্তান, প্যালেস্টাইন, বসনিয়া, মায়ানমার প্রভৃতি দেশে সহিংসতা চলছে। এসব দেশে বিভিন্ন ধর্মের কারণেই শুধু নয়, একই ধর্মের বিভিন্ন গোত্র-সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হচ্ছে। কাজেই সাম্প্রদায়িকতার কারণে বিশ্বশান্তি, মানুষের মধ্যে ঐক্য, সংহতি বজায় থাকছে না; সর্বোপরি লঙ্ঘিত হচ্ছে মানবতা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়োজনীয়তা : মানুষের ব্যক্তিগত থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একান্ত জরুরি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে সমাজ, রাষ্ট্র ও দেশের কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনাই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। কাজেই জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য। মানুষে মানুষে হানাহানি, কাটাকাটি কখনোই মানবসমাজের অগ্রগতির সহায়ক নয়। পৃথিবীর বুক থেকে তাই সাম্প্রদায়িকতা ও সকল প্রকার সংকীর্ণতার উচ্ছেদ সাধন করা একান্ত জরুরি। কারণ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রবেশ করে সামাজিক মানুষের সুখশান্তি নষ্ট করে, জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়। বিশ্বজনীন সম্প্রতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই পৃথিবীতে শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। সম্প্রীতিই মানবজীবনের শিক্ষা, সংস্কৃতির মাধ্যমেই সভ্যতার ক্রমোন্নতি ও ক্রমধারা বজায় রাখা। এসব কারণেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিশেষ প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বাংলাদেশ : বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম। ইসলাম ধর্ম ছাড়াও এদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি ধর্মের লোক বসবাস করে। মুসলমানরা এখানে স্বাধীনভাবে ঈদসহ তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে। হিন্দুরা দুর্গাপূজাসহ বারো মাসে তের পার্বণ পালন করে, বৌদ্ধরা বৌদ্ধ পূর্ণিমা, খ্রিস্টানরা ইস্টার সানডে ও বড়দিনের উৎসব পালন করে। এসব উৎসব পালনে এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ করে না, বরং পরস্পর পরস্পরের আচার অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ পায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখেই এদেশে ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এভাবে বাংলাদেশকে বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে গভীর সংহতি ও ঐক্য তা জাতীয় ইতিহাসে গৌরবময় ঐতিহ্য হয়ে আছে। বহুকাল থেকেই এদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রেখে চলছে। বাঙালি হিন্দু-মুসলমানরা একত্র হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে। ১৯৭১ সালে এদেশের হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, বাঙালি-অবাঙালি সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষিত হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের লোক নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। এখানে প্রতিটি ধর্মের মানুষ তাদের স্ব-স্ব ধর্ম, স্বাধীনভাবে পালন করে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারে। সমান নাগরিক সুবিধাদি ভোগ করতে পারে। এখানকার মানুষ একে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একে অন্যের মতের প্রতি সহিষ্ণু। রাজনৈতিক কারণে মতবিরোধ থাকলেও জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকাশ : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই উন্নতি ও সমৃদ্ধির জন্য অসাম্প্রদায়িক চেতনার ব্যাপক বিকাশ দরকার কারণ কোনো দেশে সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্ক বজায় না রেখে কোনো উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। জাতীয় অর্থনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অপরিহার্য। কাজেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিকাশের বিকল্প নেই। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিকাশের জন্য পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, আন্তরিক মেলামেশো, পরোপকারী মনোভাব, ধর্ম-বর্ণ, জাতি-গোত্র ভেদ উপেক্ষা করে একই স্রস্টার সৃষ্টি বলে এবং একই দেশের লোক বলে নিজের মানুষ হিসেবে এক জাতি মনে করা উচিত। কালো-সাদার ব্যবধান দূর করে পরস্পর স্নেহ-মমতার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, নিজের মধ্যে সুকুমার বৃত্তির লালন করা, সব ধর্মের সারবস্তু সম্পর্কে সঠিক তত্ত্বজ্ঞান অর্জন করা, কল্যাণব্রতী হয়ে সব মানুষের জন্য কাজ করা দরকার। আত্মীয়-অনাত্মীয় নয়, সব মানুষকে ভাই মনে করা উচিত। আর এগুলো চর্চার মাধ্যমেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বকাশ ঘটে। শান্তি প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মানুষের জীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে শান্তির উৎস। আর বিশ্বজনীন শান্তি ও সম্প্রীতির মধ্যেই মানুষের কল্যাণ নিহিত। আজ বিশ্বে যেখানে যত অশান্তি বিরাজ করছে সেখানে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোত্র ইত্যাদি ভেদবুদ্ধির অশান্তি দূর করার জন্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিকল্প নেই। স্রষ্টা মানুষকে বিবেক-বুদ্ধি দিয়ে যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে স্থান দিয়েছেন তার জন্য মানুষকে অবশ্যই বিবেকবান ও মানবতাবাদী হতে হবে। ধর্ম-বর্ণের ভেদবুদ্ধি, সাদা-কালোর বৈষম্যকে আজকের সভ্য জগৎ থেকে উৎখাত করতে হবে। বিশ্বশান্তির জন্য মানুষ আজ রুখে দাঁড়িয়েছে শান্তি-শৃঙ্খলাবিরোধীদের বিরুদ্ধে। মানবতার অমৃতবাণী ছড়িয়ে পড়ছে দিকে দিকে। মানুষ আজ মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করেছে। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ মঙ্গল বার্তা ইথারে ভেসে পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। সবাই চায় বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। উপসংহার : এই পৃথিবী জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষেরই বাসভূমি। পৃথিবীতে বাইরের চেহারায় মানুষের মধ্যে সাদা-কালো ব্যবধান থাকলেও সব মানুষের ভেতরের রং এক এবং অভিন্ন। তবু মানুষ জাতিভেদে, গোত্রভেদ, বর্ণভেদ, বংশকৌলীন্য ইত্যাদি কৃত্রিম পরিচয়ে নিজেদের মানুষ পরিচয়টিকে সংকীর্ণ ও গণ্ডিবদ্ধ করে ফেলে। কিন্তু সারাবিশ্বের সঙ্গে মানুষের যে সম্পর্ক সেই বিচারে মানুষের আসল পরিচয় হচ্ছে সে মানুষ। তাই দেশে দেশে, মানুষে মানুষে ধর্ম ও বর্ণের পার্থক্য সৃষ্টি করে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা উচিত নয়।