ভূমিকা: মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে বেড়েছে মানুষের ব্যস্ততা। মানুষ তার জীবনের মান উন্নয়নের জন্য সব সময়ই হচ্ছে ক্লান্ত। প্রতিনিয়ত ছুটে চলেছে অধিক সাফল্যের পেছনে। মানুষের এই কর্মময় জীবনে তাকে একটুখানি বিরতি এনে দেয় খেলাধুলা। জীবনের সাথে সংগ্রামরত মানুষকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য জীবনকে উপভোগ করতে শেখায় এই খেলাধুলা। মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলাধুলা একদিকে মানুষকে যেমন শক্তি ও সাহস দেয় অন্যদিকে তা প্রেরণারও উৎস। নিয়মিত ও পরিমিত খেলাধুলা মানুষকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করে। খেলাধুলার জয় পরাজয় থেকে মানুষ খুব সহজে জীবনের জয়-পরাজয়গুলোকেও মেনে নিতে শেখে। খেলাধুলার উদ্ভব ও বিকাশ: সভ্যতা শুরুর কিছুকাল পর থেকেই খেলাধুলার উদ্ভব হয় এবং ধীরে ধীরে তা ক্রমবিকাশ লাভ করে, এখনো করছে। অনেকে মনে করেন প্রাচীন মেসোপটেমিয়া অর্থাৎ বর্তমান ইরাকে খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ বছরেরও আগে প্রথম খেলার সূচনা হয়। আর তা হলো কুস্তি খেলা। একই সময়ে মুষ্টিযুদ্ধ, অসিযুদ্ধ ও দৌড়ের মতো খেলাগুলোরও জন্ম হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে মিশরে খেলা হিসেবে শিকারের প্রচলন ছিল। প্রাচীন রোমে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ এর দিকে মল্লযুদ্ধের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। তবে খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ অব্দে প্রাচীন গ্রীসের অলিম্পিকের সূত্রপাত হলো খেলাধুলার ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। সেই অলিম্পিকই নতুন রূপে এখনও বিশ্বের সর্ববৃহৎ খেলাধুলার আসরের নাম। এখন সারাবিশ্বে বিভিন্ন ধরণের খেলা প্রচলিত। পোলো, স্কেটিং, সাঁতার, টেনিস, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, ক্রিকেট, ফুটবল, হকি, বাস্কেটবল, রাগবি, হ্যান্ডবলসহ বিভিন্ন খেলা নানা দেশে জন্ম নিয়েছে। বিনোদন হিসাবে খেলাধুলা: অতীতকাল থেকেই খেলাধুলা বিনোদনের নির্ভেজাল মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। বর্তমানকালে যদিও বিনোদনের হাজারো উপাদান-উপকরণ সৃষ্টি হয়েছে তবু খেলার আবেদন এতটুকুও কমেনি। প্রত্যেকটি খেলাই যেন বিনোদনে ঠাসা। খেলাধুলা মানুষকে আনন্দ দেয়, উচ্ছ্বসিত করে তোলে। খেলাধুলা আমাদের আবেগ প্রকাশের বড় একটি মাধ্যম। এই খেলাধুলা কখনো মানুষকে হাসায় আবার কখনো কাঁদায়। বিনোদন হিসেবে খেলার উপযোগীতা এমন যে মানুষ দূর-দূরান্তে এমন কি দেশের বাইরেও খেলা দেখতে যায়। তাই সন্দেহাতীত ভাবেই খেলা নির্মল বিনোদনের উৎস। খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা: খেলা যে আমাদেরকে শুধু বিনোদন দেয় এমন নয়, বরং আমাদের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবন পর্যন্ত-এর রয়েছে এক সুদূর প্রসারী প্রভাব। খেলাধুলার মাধ্যমে একটি শিশুর মানসিক বিকাশ ত্বরান্বিত হয়, সামাজিকীকরণ সুসংহত হয়। ব্যক্তিজীবনে খেলাধুলা মানুষকে সৎ, সাহসী, আত্মপ্রত্যয়ী, পরিশ্রমী, অধ্যবসায়ী করে তোলে। আবার জাতীয় জীবনে খেলাধুলা মানুষের মধ্যে ঐক্য, সংহতি, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ প্রবল করে তোলে। তাই খেলাধুলার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতেও খেলাধুলা সহায়ক ভূমিকা রাখে। আন্তঃদেশীয় সুসম্পর্কের সূচনা করে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, সহযোগীতা ও আস্থার সম্পর্ক তৈরিতে খেলাধুলা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মানসিক বিকাশে খেলাধুলা: শিশুর মানসিক বিকাশে খেলাধুলার ভূমিকা খুবই সহায়ক ও স্বতঃস্ফূর্ত। শিশুর মনে খেলাধুলা এক ধরণের ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফলে শিশু ইতিবাচকভাবে বেড়ে ওঠে। খেলাধুলার ফলে যে আনন্দময় পরিবেশে শিশু বড় হয় তা তাকে উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত, আনন্দমুখর করে তোলে। এর ফলে শিশুর মানসিক বিকাশ সহজ ও সাবলীল হয়। শিশুর মনে কোনো জটিলতা তৈরি হয় না। শিশু যখন খেলাধুলায় মগ্ন হয় তখন সে তার সঙ্গীর সাথে খেলার উপকরণ ভাগাভাগী করে এবং মনের ভাব প্রকাশ করে। এর মাধ্যমে শিশুর সামাজিকীকরণ ঘটে। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও দেখা যায়, যে সকল শিশু খেলাধুলা থেকে বিরত থাকে, অন্য শিশুদের থেকে তাদের মানসিক বিকাশ বেশি ব্যহত হয়। শৃঙ্খলাবোধ তৈরিতে খেলাধুলা: একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলাবোধ যেমন জরুরি তেমনি একটি সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্যও শৃঙ্খলা মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কারণ বিশৃঙ্খল সমাজ ও রাষ্ট্র হলো চরম নৈরাজ্যের স্থান। খেলাধুলা মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করে তাদেরকে একটি সুশৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। প্রত্যেকটি খেলায় কিছু নিয়মকানুন থাকে। খেলাধুলা করতে হলে সেসব নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। দলের অন্যদের সাথে ঐক্য তৈরি করতে হয়। দলের প্রতি অনুগত থাকতে হয়। নিয়মিত অনুশীলন করতে হয়। দলের প্রধান কিংবা প্রশিক্ষককে মেনে চলতে হয়। আর এসব কিছু করতে গিয়ে মানুষের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ জন্ম নেয়। শৃঙ্খলাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ একটি গোছানো, পরিপাটি জীবনযাপন করে, নিজের উন্নতি সাধন করে। চরিত্র গঠনে খেলাধুলা: ব্যক্তির চরিত্র গঠনে ও খেলাধুলার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। খেলাধুলার মাধ্যমে মানুষের চরিত্রে দৃঢ়তা আসে। খেলাধুলা করতে ধৈর্য ও সংযম উভয়েরই প্রয়োজন হয়। ফলে যারা খেলাধুলা করে তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ও চরিত্রের মধ্যে এই দুটির ছাপ পড়ে। খেলাধুলায় জয়ের আনন্দ থাকে আবার পরাজয়ের গ্লানি থাকে এবং ফলাফল যেটাই হোক মানুষ সেটাই মানতে বাধ্য থাকে। এর ফলে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনেও যেকোনো বিষয়ে জয়-পরাজয় সহজভাবে মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়। যে ব্যক্তি খেলাধুলার সময় সৎ থাকে, অন্যকে ধোঁকা দেয়া থেকে বিরত থাকে। ব্যক্তিগত জীবনেও সেই ব্যক্তি সৎ হয়। খেলাধুলার মাধ্যমে ব্যক্তির চরিত্রে আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় প্রত্যয়, অধ্যবসায়ের মতো মানসিক গুণাবলীগুলো যুক্ত হয়। সম্প্রীতির বন্ধন তৈরিতে খেলাধুলা: খেলাধুলার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়। খেলাধুলা করতে গিয়ে একজন আর একজনের সাথে খেলতে হয়। অন্যের সাহায্য নিতে হয়, অন্যের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে হয়। দলের একজন খেলোয়াড়ের উপর অন্যজনের নির্ভরতা থাকে। খেলার মধ্যে সৃষ্ট পরস্পরের প্রতি এই আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতা মানুষের ভেতরে সম্পর্ক তৈরি করে। সেই সম্পর্ক সহযোগিতার, সৌহার্দ্যরে ও সম্প্রীতির। খেলাধুলা যে শুধুমাত্র খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে তা নয়। বরং খেলার দর্শক সমর্থকদের মধ্যেও এক ধরণের সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করে। জাতীয়তাবোধ তৈরিতে খেলাধুলা: খেলাধুলা মানুষের ভেতর জাতীয়তাবোধ তৈরি করে। কারণ খেলাধুলা এমন একটি বিষয় যা একটি দেশের সকল মানুষকে এক বিন্দুতে এনে দাঁড় করাতে পারে। আমরা আমাদের নিজেদেরকেই এর উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি। আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের যেকোনো খেলায়, তাদের সাফল্যে, ব্যর্থতায়, জয়-পরাজয়ে আমরা বাঙালি জাতি এক হয়ে যাই। ধর্ম, বর্ণ, জাত, রাজনৈতিক পরিচয়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা এক পতাকার নিচে চলে আসি। নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসা, টান উপলব্ধি করি। যখন একজন খেলোয়াড় অন্য দেশের বিরুদ্ধে খেলতে নামে তখন সে তার দেশের সকল মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নামে। ফলে তার খেলার মধ্যে তার জাতীয়তাবোধ ফুটে উঠে। পুরো দেশের মানুষকে সে জাতীয়তাবোধে উদ্ধুদ্ধ করে। সে যেন সমস্ত দেশ ও জাতির প্রতিনিধি। পুরো জাতিকে সে একই সাথে আবেগে ভাসায়। আমাদের সব কিছু নিয়েই নিজেদের মধ্যে দ্বিমত থাকতে পারে কিন্তু এই খেলার জায়গায় আমরা বাঙালি জাতি জাতীয়তাবোধে উজ্জীবিত হয়ে এক হয়ে যাই। বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ তৈরিতে খেলাধুলা: অতীতকাল থেকেই একটি দেশের সাথে অন্য একটি দেশের সুসম্পর্ক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক