আইয়ুব (আঃ)-এর পরিচয় হযরত আইয়ূব (আঃ) ছবরকারী নবীগণের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় এবং অনন্য দৃষ্টান্ত ছিলেন। ইবনু কাছীরের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ইসহাক (আঃ)-এর দুই যমজ পুত্র ঈছ ও ইয়াকূবের মধ্যেকার প্রথম পুত্র ঈছ-এর প্রপৌত্র ছিলেন। আর তাঁর স্ত্রী ছিলেন ইয়াকূব-পুত্র ইউসুফ (আঃ)-এর পৌত্রী ‘লাইয়া’ বিনতে ইফরাঈম বিন ইউসুফ। কেউ বলেছেন, ‘রাহমাহ’। তিনি ছিলেন স্বামী ভক্তি ও পতিপরায়ণতায় বিশ্বের এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে তিনি ‘বিবি রহীমা’ নামে পরিচিত। তাঁর পতিভক্তি বিষয়ে উক্ত নামে জনপ্রিয় উপন্যাস সমূহ বাজারে চালু রয়েছে। অথচ এ নামটির উৎপত্তি কাহিনী নিতান্তই হাস্যকর। পবিত্র কুরআনে সূরা আম্বিয়া ৮৪ আয়াতে رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا (‘আমি আইয়ূবকে.... আরও দিলাম আমার পক্ষ হতে দয়া পরবশে’) বাক্যাংশের ‘রাহমাতান’ বা ‘রাহ্মাহ’ (رَحْمَةً) শব্দটিকে ‘রহীমা’ করে এটিকে আইয়ূবের স্ত্রীর নাম হিসাবে একদল লোক সমাজে চালু করে দিয়েছে। ইহুদী-নাছারাগণ যেমন তাদের ধর্মগ্রন্থের শাব্দিক পরিবর্তন ঘটাতো, এখানেও ঠিক ঐরূপ করা হয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ যেন বলছেন যে, আইয়ূবের স্ত্রী রহীমা তার স্বামীকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। পরে আমরা তাকে আইয়ূবের কাছে ফিরিয়ে দিলাম’। বস্ত্ততঃ এটি একটি উদ্ভট ব্যাখ্যা বৈ কিছু নয়। মূলতঃ আইয়ূবের স্ত্রীর নাম কি ছিল, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য কুরআন বা হাদীছে নেই। এ বিষয়ের ভিত্তি হল ইহুদী ধর্মনেতাদের রচিত কাহিনী সমূহ। যার উপরে পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন করাটা নিতান্তই ভুল। তাফসীরবিদ ও ঐতিহাসিকগণ আইয়ূবের জনপদের নাম বলেছেন ‘হূরান’ অঞ্চলের ‘বাছানিয়াহ’ এলাকা। যা ফিলিস্তীনের দক্ষিণ সীমান্ত বরাবর দামেষ্ক ও আযরূ‘আত-এর মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থিত।[আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ, ১/২০৬-১০ পৃঃ; কুরতুবী, ছোয়াদ ৪১] পবিত্র কুরআনে ৪টি সূরার ৮টি আয়াতে আইয়ূব (আঃ)-এর কথা এসেছে। যথা- নিসা ১৬৩, আন‘আম ৮৪, আম্বিয়া ৮৩-৮৪ এবং ছোয়াদ ৪১-৪৪। আল্লাহ বলেন, وَأَيُّوْبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّيْ مَسَّنِيَ الضُّرُّ وَأَنْتَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ- فَاسْتَجَبْنَا لَهُ فَكَشَفْنَا مَا بِهِ مِنْ ضُرٍّ وَّآتَيْنَاهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ رَحْمَةً مِّنْ عِنْدِنَا وَذِكْرَى لِلْعَابِدِيْنَ- ‘আর স্মরণ কর আইয়ূবের কথা, যখন তিনি তার পালনকর্তাকে আহবান করে বলেছিলেন, আমি কষ্টে পতিত হয়েছি এবং আপনি সর্বোচ্চ দয়াশীল’। ‘অতঃপর আমি তার আহবানে সাড়া দিলাম এবং তার দুঃখ-কষ্ট দূর করে দিলাম। তার পরিবারবর্গকে ফিরিয়ে দিলাম এবং তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আরও দিলাম আমার পক্ষ হতে দয়া পরবশে। আর এটা হল ইবাদতকারীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ’ (আম্বিয়া ২১/৮৩-৮৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَاذْكُرْ عَبْدَنَا أَيُّوْبَ إِذْ نَادَى رَبَّهُ أَنِّيْ مَسَّنِيَ الشَّيْطَانُ بِنُصْبٍ وَعَذَابٍ، ارْكُضْ بِرِجْلِكَ هَذَا مُغْتَسَلٌ بَارِدٌ وَشَرَابٌ، وَوَهَبْنَا لَهُ أَهْلَهُ وَمِثْلَهُم مَّعَهُمْ رَحْمَةً مِّنَّا وَذِكْرَى لِأُوْلِي الْأَلْبَابِ، وَخُذْ بِيَدِكَ ضِغْثاً فَاضْرِب بِّهِ وَلاَ تَحْنَثْ إِنَّا وَجَدْنَاهُ صَابِراً نِعْمَ الْعَبْدُ إِنَّهُ أَوَّابٌ-(ص ৪১-৪৪)- ‘আর তুমি বর্ণনা কর আমাদের বান্দা আইয়ূবের কথা। যখন সে তার পালনকর্তাকে আহবান করে বলল, শয়তান আমাকে (রোগের) কষ্ট এবং (সম্পদ ও সন্তান হারানোর) যন্ত্রণা পৌঁছিয়েছে’ (ছোয়াদ ৩৮/৪১)। ‘(আমি তাকে বললাম,) তুমি তোমার পা দিয়ে (ভূমিতে) আঘাত কর। (ফলে পানি নির্গত হল এবং দেখা গেল যে,) এটি গোসলের জন্য ঠান্ডা পানি ও (পানের জন্য উত্তম) পানীয়’ (৪২)। ‘আর আমি তাকে দিয়ে দিলাম তার পরিবারবর্গ এবং তাদের সাথে তাদের সমপরিমাণ আমার পক্ষ হতে রহমত স্বরূপ এবং জ্ঞানীদের জন্য উপদেশ স্বরূপ’ (৪৩)। ‘(আমি তাকে বললাম,) তুমি তোমার হাতে একমুঠো তৃণশলা নাও। অতঃপর তা দিয়ে (স্ত্রীকে) আঘাত কর এবং শপথ ভঙ্গ করো না (বরং শপথ পূর্ণ কর)। এভাবে আমি তাকে পেলাম ধৈর্যশীল রূপে। কতই না চমৎকার বানদা সে। নিশ্চয়ই সে ছিল (আমার দিকে) অধিক প্রত্যাবর্তনশীল’ (ছোয়াদ ৩৮/৪১-৪৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِيْنَ ‘আর এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কৃত করে থাকি’ (আন‘আম ৬/৮৪)। অতঃপর আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, আইয়ূব একদিন নগ্নাবস্থায় গোসল করছিলেন (অর্থাৎ বাথরুম ছাড়াই খোলা স্থানে)। এমন সময় তাঁর উপরে সোনার টিড্ডি পাখি সমূহ এসে পড়ে। তখন আইয়ূব সেগুলিকে ধরে কাপড়ে ভরতে থাকেন। এমতাবস্থায় আল্লাহ তাকে ডেকে বলেন, হে আইয়ূব! أَلَمْ اَكُنْ أُغْنِيَنَّكَ عَمَّا تَرَى؟ আমি কি তোমাকে এসব থেকে মুখাপেক্ষীহীন করিনি? আইয়ূব বললেন, بَلَى وَعِزَّتِكَ ولكن لاغِنَى بِى عَنْ بَرَكَتِكَ তোমার ইযযতের কসম! অবশ্যই তুমি আমাকে তা দিয়েছ। কিন্তু তোমার বরকত থেকে আমি মুখাপেক্ষীহীন নই’।[বুখারী, মিশকাত হা/৫৭০৭]