মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ আউস ও খাযরাজ নেতাগণ আগেই ইসলাম কবুল করায় এবং আউস ও খাযরাজ দুই প্রধান গোত্রের আমন্ত্রণ থাকায় তাদের সাথে সন্ধিচুক্তির কোন প্রশ্নই ছিল না। খাযরাজ গোত্রের আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই নেতৃত্বের অভিলাষী থাকলেও গোত্রের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের বিরুদ্ধে গিয়ে প্রকাশ্যে কিছু করার ক্ষমতা তার ছিল না। বদর যুদ্ধের পর সে এবং তার অনুসারীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুল করে। তবে সেসময় মদীনার সংখ্যালঘু ইহূদী সম্প্রদায় মুসলমানদের নবতর জীবনধারার প্রতি এবং বিশেষভাবে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ঈর্ষান্বিত থাকলেও অতি ধূর্ত হওয়ার কারণে প্রকাশ্য বিরোধিতায় লিপ্ত হয়নি। সমস্যা ছিল কেবল কুরায়েশদের নিয়ে। তারা পত্র প্রেরণ ও অন্যান্য অপতৎপরতার মাধ্যমে মুনাফিক ও ইহূদীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে রাসূল (সাঃ) ও তার সাথীদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কারের সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে থাকে। একাজে তারা যাতে সফল না হয় সেজন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম মদীনার পার্শ্ববর্তী এলাকার লোকদের সাথে সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।
সেকারণ তিনি পার্শ্ববর্তী নিকট ও দূরের এলাকাসমূহের বিভিন্ন গোত্রের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন। যেমন, (১) ২য় হিজরীর ছফর মাসে মদীনা হতে ২৯ মাইল দূরবর্তী ওয়াদ্দান (ودَّان) এলাকায় এক অভিযানে গেলে রাসূল (সাঃ) সেখানকার বনু যামরাহ(بَنُو ضَمْرَة) গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। (২) অতঃপর ২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে বুওয়াত্ব (بُواط) এলাকায় এক অভিযানে গিয়ে রাসূল (সাঃ) তাদের সাথেও সন্ধিচুক্তি করেন। (৩) একই বছরের জুমাদাল আখেরাহ মাসে ইয়াম্বু‘ ও মদীনার মধ্যবর্তী যুল-‘উশায়রা(ذُو الْعُشَيْرَة) এলাকায় গিয়ে তিনি বনু মুদলিজ(بَنُو مُدْلِج) গোত্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। এভাবে রাসূল (সাঃ) চেয়েছিলেন, যেন যুদ্ধাশংকা দূর হয় এবং সর্বত্র শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু এসময় মদীনায় ইহূদী চক্রান্ত চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। যার নেতৃত্বে ছিল তাদের ধনশালী নেতা ও ব্যঙ্গ কবি কা‘ব বিন আশরাফ। রাসূল (সাঃ), সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের স্ত্রীদের নিয়ে কটূক্তি করাই ছিল তার বদস্বভাব।
এ বিষয়ে সহীহ সনদে কা‘ব বিন মালেক আনছারী (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, ইহূদী নেতা কা‘ব বিন আশরাফ রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা বলত এবং কাফের কুরায়েশদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে উস্কানী দিত। অতঃপর রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় আসেন, তখন এখানে মিশ্রিত বাসিন্দারা ছিল। তাদের মধ্যে মুসলমানেরা ছিল। মুশরিকরা ছিল, যারা মূর্তিপূজা করত। ইহূদীরা ছিল, যারা রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের কষ্ট দিত। এমতাবস্থায় আল্লাহ স্বীয় নবীকে ছবর ও মার্জনার আদেশ দিয়ে আয়াত নাযিল করেন,لَتُبْلَوُنَّ فِي أَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَلَتَسْمَعُنَّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَمِنَ الَّذِينَ أَشْرَكُوا أَذًى كَثِيرًا وَإِنْ تَصْبِرُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ ذَلِكَ مِنْ عَزْمِ الْأُمُورِ ‘অবশ্যই তোমরা পরীক্ষায় পতিত হবে তোমাদের ধন-সম্পদে ও তোমাদের নিজেদের জীবনে। আর তোমরা অবশ্যই শুনবে তোমাদের পূর্ববর্তী আহলে কিতাব ও মুশরিকদের কাছ থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা। যদি তোমরা তাতে ধৈর্য ধারণ কর এবং আল্লাহভীরুতা অবলম্বন কর, তবে সেটাই হবে দৃঢ় সংকল্পের কাজ’ (আলে ইমরান ৩/১৮৬)। অতঃপর যখন কা‘ব বিন আশরাফ রাসূল (সাঃ)-কে কষ্টদানে বিরত থাকতে অস্বীকার করল, তখন রাসূল (সাঃ) আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে তার বিরুদ্ধে একদল লোক পাঠাতে বললেন, যেন তারা তাকে হত্যা করে। তখন তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে পাঠালেন। অতঃপর তিনি (রাবী) তার হত্যার কাহিনী বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ইহূদী ও মুশরিকরা ভীত হয়ে পড়ে। ফলে পরদিন তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে হাযির হয়ে বলল, আমাদের নেতাকে রাতের বেলায় তার বাড়ীতে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তখন রাসূল (সাঃ) তাদেরকে তার ব্যঙ্গ কবিতার কথা বললেন। অতঃপর তিনি তাদের বললেন তাঁর ও তাদের মধ্যে একটা লিখিত চুক্তি সম্পাদন করতে। যাতে তারা যেসব গালি ও কষ্ট দেয়, তা থেকে বিরত হয়। অতঃপর নবী (সাঃ) তাঁর ও তাদের মধ্যে এবং মুসলমানদের মধ্যে একটা চুক্তিনামা (صَحِيفَة) লিখে দিলেন’ (আবুদাঊদ হা/৩০০০)।
অত্র হাদীছ দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, চুক্তি লিখনের এই বিষয়টি হিজরতের পরেই নয়, বরং ৩য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে কা‘ব বিন আশরাফের হত্যাকান্ডের পরে হয়েছিল। যা অধিকাংশ জীবনীকার ও ইতিহাসবিদগণের বক্তব্যের বিরোধী। যেমন মুবারকপুরী বলেন, ‘মদীনায় হিজরতের পরপরই নবগঠিত ইসলামী সমাজের বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য’ রাসূল (সাঃ) মদীনার সনদ রচনা করেন (আর-রাহীক্ব ১৯২ পৃঃ)। অথচ বিষয়টি সহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়। নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক বর্ণনার চাইতে সহীহ হাদীছের গুরুত্ব সর্বাধিক।
জীবনীকারগণ উপরোক্ত সহীহ হাদীছের জওয়াবে বলেন,