সবুজে শ্যামলে ভরা আমাদের এ দেশের বেশির ভাগ স্থান জুড়ে রয়েছে গ্রাম। আমাদের গ্রামগুলো যেন সবুজের লীলাভূমি।গ্রামের সবুজ প্রকৃতি যে কোনো মানুষের মনকে প্রশান্তি দেয়। পল্লীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও অর্থনীতি। পল্লীই এদেশের প্রাণ। কিন্তু পল্লীর সে শোভা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের অবহেলার কারণে। অভাব আর দারিদ্র্যের কারণে পল্লীর মানুষ আজ জর্জরিত। একটু ভালোভাবে বাঁচার জন্য গ্রামের মানুষ এখন শহরমুখী হচ্ছে। ফলে জনশূন্য হতে চলেছে গ্রামের পর গ্রাম। পল্লীর প্রতি মুগ্ধতায় কবি কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে ‘আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ। -বন্দেআলী মিয়া পল্লী উন্নয়ন কী: পল্লী উন্নয়ন বলতে পল্লীর মানুষের মৌলিক চাহিদাপূরণ, বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মমুখী করা, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, সম্পদের সুষম বণ্টন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নকে বুঝায়। গ্রামীণ পরিসরে মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান ও জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নই হলো পল্লী উন্নয়ন। প্রাচীনকালের পল্লী: ‘চাষী ক্ষেতে চালাইতো হাল, তাঁতি বসে তাঁত বোনে, জেলে ফেলে জাল বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার। তারি পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার। -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীনকালে পল্লীর রূপ ছিল এই রকম। দেশের প্রাণ এই গ্রাম ছিল রূপকথার মতো। সুখ, শান্তি, স্বাস্থ্য সমৃদ্ধি, আনন্দ, উৎসব ছিল পল্লীর প্রধান বৈশিষ্ট্য। গ্রামের মানুষের ছিল গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, উৎসবের আমেজ, কুটির শিল্প এবং একে অপরের মধ্যে সহমর্মিতা ও ভালোবাসা। প্রাচীনকালে এদেশের মসলিন কাপড়, জামদানি শাড়ি, মাটির তৈজসপত্র, নকশীকাঁথা দেশের বাহিরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। গ্রাম ছিল সবুজে আর সমৃদ্ধিতে প্রাণবন্ত। বর্তমান পল্লী: রূপসী বাংলার পল্লী প্রকৃতি আজ হয়ে পড়েছে জৌলুসহীন, মলিন। গোলাভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছ আজ নেই। পল্লী জীবনের উৎসবময় পরিবেশ আজ বিপন্ন। সংস্কারের অভাবে পুকুরগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে, ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব আর দেখা যায় না, মাঠে প্রান্তরে রাখালের সেই বাঁশির সুর আর শোনা যায় না। গাছে গাছে পাখির কলকাকলি হারিয়ে যাচ্ছে। আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই তথা মৌলিক চাহিদা পূরণের অভাবে গ্রামের মানুষগুলো ধুঁকে ধুঁকে মরছে। পশ্চাদপদতার কারণ: আমাদের গ্রামগুলোর পিছিয়ে পড়ার মূলে রয়েছে অভাব, অশিক্ষা এবং কুসংস্কার। কর্মসংস্থানের অভাব বেকারত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। পূর্বে পল্লীতে কুটির শিল্পের প্রচলন ছিল, মানুষ কুটির শিল্পের কাজ করে বেশ উপার্জন করত। কিন্তু বর্তমান আধুনিক যুগে যান্ত্রিক শক্তির সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কুটির শিল্প আজ ধ্বংসের সম্মুখীন হয়েছে। রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষি উৎপাদনে কৃষকেরা লাভবান হতে পারছে না। গ্রামের রাস্তাঘাটের বেহাল দশার কারণে উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ফলে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কৃষকেরা। সরকারি, বেসরকারি সাহায্যের অভাবে পিছিয়ে পড়ছে পল্লী। পল্লীর মানুষের শহরমুখীতা: বর্তমান যুগে পল্লীর মানুষ শহরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গ্রামে কাজ ও খাদ্যের অভাবে গরীব কৃষকেরা শহরের দিকে ছুটছে। পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং মানসম্মত শিক্ষার অভাব শিক্ষার্থীরা আজ শহরমুখী। গ্রামে ভালো হাসপাতাল ও চিকিৎসকের অভাবে মানুষকে প্রতিনিয়ত ছুটতে হচ্ছে শহরের দিকে। কৃষি উৎপাদনে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে কৃষকেরা শহরে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে। গ্রামের দিন মজুরেরা কাজ না পেয়ে শহরে কল-কারখানাকে শ্রমিক হিসেবে কাজ নিচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গ্রামের মানুষ সর্বশান্ত হয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে শহরে গড়ে উঠেছে কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, সেখানে প্রচুর শ্রমিকের কাজের সুযোগ রয়েছে, তাই মানুষ কাজ করতে শহরে আসছে। শহরে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, দেশের নামকরা হাসপাতাল এবং ডাক্তারও মেলে শহরে, আধুনিক প্রযুক্তিও এখন শহরে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। তাই মানুষ সকল সুযোগ সুবিধার আশায় শহরমুখী হচ্ছে। পল্লী উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা: দেশকে উন্নত করতে হলে, গ্রামকে বাঁচাতে হবে। আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি, আর কৃষির ভিত্তি হলো পল্লী। পল্লী উন্নয়ন ব্যতীত দেশের জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। পল্লীতে যেহেতু বেশির ভাগ লোক বাস করে তাই পল্লীর দিকেই আমাদের নজর দিতে হবে। পল্লীর প্রত্যেকটি মানুষকে জনসম্পদে পরিণত করতে হবে। পল্লীতে কাজের জন্য অনুকূল পরিবেশ বিদ্যমান, শুধু প্রয়োজন কর্মমুখী শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা। দেশের বিশাল অংশজুড়ে রয়েছে গ্রাম তাই গ্রামের মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। পল্লী উন্নয়নের উপায়: পল্লী উন্নয়নের জন্য যে সব বিষয়ে নজর দিতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে সেগুলো হলো- * দারিদ্র্য দূরীকরণ। * জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন * স্বল্প ব্যয়ে মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা। * সম্পদের সুষম বণ্টন। * কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি। * চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। * যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। * কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। * কৃষির আধুনিকায়ন * জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি। * বিনোদন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা। * আধুনিক প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো। * পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন। পল্লী উন্নয়ন প্রক্রিয়া ও কৌশল: পল্লী উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। কৌশলগুলো হলো- ক) শিক্ষার প্রসার: গ্রামে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। নারী শিক্ষার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। বয়স্ক এবং কর্মঠ মানুষের জন্য নৈশ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। খ) স্বাস্থ্য উন্নয়ন: দরিদ্র গ্রামীণ জনগণের জন্য কমিউনিটি হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। সময়মতো টিকা প্রদান করে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমাতে হবে। গ) কুটির শিল্পের উন্নয়ন: অর্থনৈতিকভাবে পল্লীকে শক্তিশালী করার জন্য কুটির শিল্প গড়ে তুলতে হবে। কুটির শিল্পের উন্নয়নে সরকারি ও বেসরকারি সহায়তা বাড়াতে পারলে পল্লী উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। ঘ) যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন: গ্রামে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সহজে বাজারজাত করার জন্য রাস্তাঘাট তৈরি, মেরামত এবং প্রয়োজনীয় সেতু, কালভার্ট ও ব্রীজ নির্মাণ করতে হবে। এছাড়াও গ্রামে পশুপালন, মাছ চাষ, বিদ্যুতের ব্যবস্থা, সমবায় সমিতি, ঋণ দেয়া এবং যুব কল্যাণ কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে। গৃহীত পদক্ষেপ: বর্তমানে আমাদের দেশের সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পল্লী উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে গ্রামে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বেকারত্ব দূরীকরণ, কৃষি উৎপাদন, পশু পালন ইত্যাদিতে পরামর্শ এবং প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। সরকার ১ জানুয়ারী ১৯৯২ সালে দেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করেছে। ১ জানুয়ারী ১৯৯৩ সালে যা সারাদেশে প্রসার লাভ করে। ১৯৮২ সালে দেশে DRDB (Bangladesh Rural