ভূমিকাঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশ্ব ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে স্বাধীনতা লাভে যাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তারা হলেন আমাদের বিদেশি বন্ধুগণ। বিদেশি বন্ধুদের আন্তরিক সমর্থন ও সাহায্যের কারণে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করতে সক্ষম হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় এবং স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিদেশি বন্ধুদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। ভিনদেশি এসব মানুষের কাছে বাংলাদেশ চিরঋণী। মুক্তিযুদ্ধের সময় এ সকল মহান ব্যক্তি ও সংগঠনের অবদান বাঙালি জাতিকে প্রাণপণ লড়াইয়ে উৎসাহ জুগিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কয়েক যুগ ধরে বাঙালিদের মনে পুতে রাখা জাতীয়তাবাদের উন্মেষের ফসল। বাঙালির স্বজাত্যবোধ প্রকাশ পেয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত ঘটিত কিছু ঘটনাবলীর ওপর ভিত্তি করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে রয়েছে ১৯৫২ সালের মাতৃভাষা বাংলার দাবীতে ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নিবার্চনে যুক্তফ্রন্টের জয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের জোরপুর্বক ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি, ১৯৬২ সালের হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা দাবী উত্থাপন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুথান এবং ১৯৭০ সালের নিবার্চন, এসব ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর মাধ্যমে বাঙালির নিজস্ব জাতি চেতনা গড়ে ওঠে। বাংলার মানুষ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্ত এবং স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠায় উজ্জীবিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলে বাঙালি জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। সারাদেশে শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। সারাদেশকে এগারটি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠন করা হয় বাংলাদেশের অন্তর্বতীকালীন সরকার। অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের রাষ্ট্রপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানের কারাগারে থাকায় উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তাদের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ নয় মাসে পাকিস্তানের রিরুদ্ধে জয়লাভ করে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যৌথবাহিনীর কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাক বাহিনীর জেনারেল এ,কে, নিয়াজি ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করে। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নেয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে বিদেশি ব্যক্তিবর্গের অবদানঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের পাশাপাশি বিদেশি অনেক ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। যাদের ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়। বিদেশিদের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারীদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিচে তুলে ধরা হলো- ইন্দিরা গান্ধীঃ ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রর বিরোধিতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন। তার অনুরোধেই জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে উত্থাপিত প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট প্রদান করে রাশিয়া। তিনি যুদ্ধের সময় ভারতে অবস্থান গ্রহণকারী বাঙালি শরণার্থীদের ক্যাম্প পরির্দশন করেন। এসময় তিনি প্রায় এক কোটি শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। আঁদ্রে মার্লোঃ আঁন্দ্রে মার্লো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে অবস্থানগ্রহণকারী বিশ্ব ব্যক্তিত্ব। তিনি ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী ও দার্শনিক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে তার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জোরালো সমর্থন গড়ে ওঠে। জর্জ হ্যারিসনঃ আমেরিকান পপ সংগীত তারকা জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ভারতের বিখ্যাত সংগীত শিল্পী পন্ডিত রবি শংকরের অনুরোধে একটি কনসার্ট করতে রাজি হন। হ্যারিসনের ব্যান্ড পার্টি ব্রিটলস ১৯৭১ সালে নিউইয়র্কের ম্যাসিন স্কয়ারে “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” নামে একটি কনসার্টের আয়োজন করেন। হ্যারিসনের ইচ্ছায় বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের নিমর্ম হত্যাযজ্ঞের স্থির চিত্র প্রদর্শিত হয়। ফলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঘৃণার সৃষ্টি হয়। হ্যারিসনের আন্তরিক চেষ্টার ফলে উক্ত কনসার্ট থেকে প্রায় আড়াই লাখ ডলার অনুদান সংগৃহিত হয়। যার সবটাই বাংলাদেশে নিপীড়নের শিকার মানুষের জন্য প্রদান করা হয়। জোয়ান বায়েজঃ বিখ্যাত সংগীত তারকা জোয়ান বায়েজ বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে গান রচনা করেন। যার শিরোনাম ছিল “বাংলাদেশ বাংলাদেশ”। তার মতো একজন বিশ্বখ্যাত তারকার বাংলাদেশ নিয়ে গান রচনা করায় বাংলাদেশর স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে বিদেশিদের টনক নড়ে। সাইমন ড্রিঃ সাইমন ড্রিং বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর প্রথম বর্হিবিশ্বে প্রচার করেন। তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্ব দরবারে পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। উথান্টঃ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব মিয়ানমারের নাগরিক উথান্টও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার বিষয়ে ইয়াহিয়া খানের কাছে উদ্বেগ জানান। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারতে আশ্রয়রত বাঙালি শরণার্থীদের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সাহায্য আসে। শ্রী-কুদরিয়া ভেৎসেবঃ ভারত সফররত সোভিয়েত প্রতিনিধি দলের নেতা শ্রী কুদরিয়া ভেৎসেবের বলিষ্ঠ ঘোষণার মাধ্যমে প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশকে সাহায্য করতে গিয়ে ভারত আক্রান্ত হলে রাশিয়া ভারতের পাশে দাঁড়াবে। ডব্লিউ এস. ওডারল্যান্ডঃ ন্যাদারল্যান্ডস এর বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলীয় নাগরিক ডব্লিউ এস. ওডারল্যান্ড বাংলাদেশের বাটা কোম্পানির কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছিলেন। তিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধের একজন যোদ্ধা ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তিনি বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেন। এ্যান্থনি মাসকারেনহাসঃ ব্রিটিশ সাংবাদিক এ্যান্থনি মাসকারেনহাসকে বাংলাদেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছিল পাকিস্তানের পক্ষে সংবাদ ছাপানোর জন্য। তিনি তা না করে বিবেকের তাড়নায় বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র বিদেশি পত্রিকায় তুলে ধরেন। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর গণহত্যা নিয়ে তার রচিত বই ‘রেইপ অব বাংলাদেশ’ এবং ‘লিগ্যাসি অব ব্লাড’। সিডনি স্যান্ডবার্গঃ নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক সিডনি স্যান্ডবার্গ পাকিস্তানি শাসকদের অপকীর্তি নিয়ে রিপোর্ট ছাপান। একারণে তাকে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বহিষ্কার করে। এডওয়ার্ড এফ. কেনেডিঃ তিনি মার্কিন কংগ্রেসের ডেমোক্রেট দলীয় সদস্য। ১৯৭১ সালে তিনি আমেরিকার পাকিস্তানঘেষা পররাষ্ট্রনীতির বড় সমালোচক ছিলেন। উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গ ছাড়াও স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং আরোরা, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোনি এবং প্রধানমন্ত্রী অ্যালেগ্রেই কেসিগিনের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। বিদেশি সংগঠনের ভূমিকাঃ বিদেশি ব্যক্তিবর্গের ভূমিকার