ভূমিকাঃ যেকোনো জাতির উন্নতির মূলে শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় শিক্ষাই তাদের উন্নতির মূল কারণ। আর তাই শিক্ষাকে সার্বজনীন করার বিষয়টি বাংলাদেশসহ প্রত্যেকটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সার্বজনীন শিক্ষার নিশ্চয়তাই যেকোনো জাতিকে সুখ, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে নিয়ে যায়। বর্তমান বিশ্বে সার্বজনীন শিক্ষার বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে। শিক্ষা কীঃ সাধারণ অর্থে জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনই হলো শিক্ষা। ব্যাপক অর্থে পদ্ধতিগত জ্ঞান লাভের প্রক্রিয়াকে শিক্ষা বলা হয়। শিক্ষার ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Education যা ল্যাটিন শব্দ Educare বা Educatum থেকে এসেছে। সার্বজনীন শিক্ষাঃ যখন কোনো দেশের নারী-পুরুষ সকলকে উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া হয় তখন তাকে গণশিক্ষা বা সার্বজনীন শিক্ষা বলা হয়। দেশের অধিকাংশ নরনারী গ্রামে বাস করে। সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হলে সবার আগে গ্রামের কথা ভাবতে হবে। যেকোনো দেশের গ্রাম-অঞ্চলের শিক্ষা নিশ্চিত হলেই সার্বজনীন শিক্ষা সম্ভব হবে। আর সার্বজনীন শিক্ষা নিশ্চিত হলে দেশের মানুষের মধ্যে চিন্তা চেতনার পরিবর্তন ঘটবে। সমাজের প্রত্যেকটি স্তরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দিয়ে জাতিকে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলাই সার্বজনীন শিক্ষার উদ্দেশ্য। সার্বজনীন শিক্ষা ও বাংলাদেশঃ বাংলাদেশে সার্বজনীন বলতে মূলত মৌলিক শিক্ষাকে বুঝানো হয়। এই মৌলিক শিক্ষা প্রাথমিক শিক্ষার মাধ্যমে দেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথম স্তর প্রাথমিক শিক্ষা। ১৯৯০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক আইন পাস হয়। ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি ৬৮টি উপজেলায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি সারাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হয়। বর্তমান সরকার গউএ অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সার্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। সার্বজনীন শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাঃ শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। তাই শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমাদের দেশের শিক্ষার হার অনেক কম। ২০১১ সালের আদম শুমারী রিপোর্ট অনুসারে বাংলাদেশের সাক্ষরতার ৫১.৮%। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সাক্ষরতার হার ঢাকা জেলায় ৭০.৫%। আবার সর্বনিন্মো সাক্ষরতার হার সুনামগঞ্জ জেলায় ৩৫.১০%। আর এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে গণশিক্ষা বা সার্বজনীন শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। শিক্ষা ব্যবস্থাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। যেকোনো দেশের উন্নয়নের প্রধান শর্ত সার্বজনীন শিক্ষা। বাংলাদেশে সার্বজনীন শিক্ষার উদ্দেশ্যঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সার্বজনীন শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কি হতে পারে তা নিন্মে বর্ণনা করা হলো- ১) নিরক্ষর লোকদের সাক্ষরতা দান এবং উৎপাদনশীল কাজে উৎসাহিত করা। ২) দরিদ্র ও মেধাবীদের মেধা বিকাশে সাহায্য করা। ৩) ন্যূনতম লেখাপড়া ও হিসাব-নিকাশের শেখানোর ব্যবস্থা করা। ৪) শিক্ষার মাধ্যমে জ্ঞান-মেধা ও মানবীয় শক্তির বিকাশ ঘটানো। ৫) নিজেদের অধিকার ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। ৬) শিক্ষার মাধ্যমে সমস্ত দেশ ও জাতিকে আলোকিত করা। বাংলাদেশে সার্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রমের সূচনাঃ বাংলাদেশের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার (১৯৮০-১৯৮৫) ভিত্তিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গণশিক্ষা কার্যক্রম হাতে নেয়। আর এই গণশিক্ষা কার্যক্রমের অন্যতম লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ অশিক্ষিতদের মধ্যে সাক্ষরতা দান এবং সচেতন করে তোলা। তাদের উদ্দেশ্য শুধু লিখানো এবং পড়ানো এর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামের সকল লোকজন যেন চিঠিপত্র পড়া, সংবাদপত্র পড়া এবং সংসারের আয় ব্যয়ের হিসাব নিকাশ প্রভৃতি কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করা। এ কাজ সফল করার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করা হয়েছিল। সার্বজনীন শিক্ষার প্রতিকূলতাঃ যদিও সরকার অনেক আগে থেকেই সার্বজনীন শিক্ষার জন্য চেষ্টা করে আসছে কিন্তু নানা প্রতিকূলতার জন্য তা বাস্তবায়নে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। নিন্মে সার্বজনীন শিক্ষার পথে প্রতিকূলতাগুলো বর্ণনা করা হলো- ১) আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীর তুলনায় বিদ্যালয় এবং শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। ২) পিতা-মাতার আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক শিশু প্রাথমিক শিক্ষাই সম্পূর্ণ করতে পারে না। ৩) অনেক অভিভাবক আছে যারা তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বিষয়ে আগ্রহী নয়। ৪) বিদেশের শিশুরা বছরে ১০০০-১২০০ ঘণ্টা বিদ্যালয়ে কাটায়। আর আমাদের দেশের শিশুরা বছরে মাত্র ৫০০-৬০০ ঘণ্টা বিদ্যালয়ে কাটায়। ৫) অনেক ছেলেমেয়ে পারিবারিক বিভিন্ন কুসংস্কার ও অন্ধ বিশ্বাসের কারণে শিক্ষা হতে বঞ্চিত হচ্ছে। এনজিও (NGO) সমূহের গণশিক্ষা কার্যক্রমঃ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানা প্রতিকূলতায় পরিপূর্ণ। আর এই প্রতিকূলতা সামনে নিয়ে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এনজিও গণশিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারে ইউনেস্কোর ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। বিনামূল্যে বই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি, চক পেন্সিল ও খাতার জন্য ইউনেস্কো নানাভাবে আর্থিক সাহায্য প্রদান করে। আবার ইউনিসেফ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শিশুদের স্কুলে যেতে উৎসাহিত করতে বিনামূল্যে বিস্কুট বিতরণ করে থাকে। এ ছাড়াও ব্র্যাক, প্রশিকা, গণসাক্ষরতা ও ওয়াল্ডভিশন প্রভৃতি এনজিও গ্রাম-অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পাালন করে আসছে। বর্তমান সরকারের সার্বজনীন শিক্ষা কার্যক্রমঃ গণশিক্ষা বা সার্বজনীন শিক্ষাকে পরিপূর্ণ রূপ দেওয়ার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিদ্যালয়, মসজিদ, ক্লাব ও বাড়ির আঙ্গিনায় বয়স্কদের শিক্ষাদানের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলোতে দুই শিফটে ক্লাস নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার স্কুলগুলোতে দুই শিফটে ক্লাস নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া বয়স্ক নারী-পুরুষদেরকে সাক্ষরতা দানের জন্য উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের ব্যবস্থা করছে। সরকারের কার্যক্রমের ফলে দেশের অনেক জেলা নিরক্ষরমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ঃ বাংলাদেশে ১৯৯২ সালে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চালু করে। আর দেশের স্বল্প শিক্ষিত লোকদের উচ্চ শিক্ষায় উৎসাহী করার জন্য উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বিশেষ পরিকল্পনায় এসএসসি কার্যক্রম চালুর মাধ্যমে দেশের ঝরে পড়া মেধা শক্তিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ঘরে বসেই বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ২ থেকে ৪ বছরের মেয়াদে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া যায়