(সংকেত: ভূমিকা; আইনের শাসন; আইনের শাসনের নীতি ও অভিব্যক্তি; আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা; আইনের শাসন ও বাংলাদেশের সংবিধান; বাংলাদেশে আইনের শাসনের বিভিন্ন দিক; আইনের শাসনে আইন বিভাগের গুরুত্ব;বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমদের করণীয়; উপসংহার।) ভূমিকা: আধুনিক বিশ্ব হলো গণতান্ত্রিক বিশ্ব। আর গণতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার মূল নির্দেশক হলো আইনের শাসন। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সরকার নিজেদেরকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। দেশ ও সরকার পদ্ধতিভেদে আইন ও সংবিধান ভিন্ন হলেও তা পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রেই বিদ্যমান। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইনের শাসন ছাড়া যেহেতু নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় না তাই গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও আইন, সংবিধান, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও প্রতিষ্ঠান সবই আছে। তবে বাংলাদেশে আইনের অপপ্রয়োগে মানুষের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। তাই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভিত্তি মজবুত করতে হলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং এজন্য আইনের সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন: রাষ্ট্র বা সরকার ব্যবস্থায় ক্ষমতার ক্ষেত্রকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:- আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগ। আঞ্চলিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসন বিভাগের ভূমিকাই তুলনামূলকভাবে বেশি। আইন বিভাগ আইন প্রণয়ন করে, আর বিচার বিভাগ আইনের ব্যাখ্যা দান, বিভিন্ন মামলায় প্রচলিত আইনের প্রয়োগ ও আইন অমান্যকারীকে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করে। শাসন বিভাগ আইন বিভাগের প্রণীত আইনসমূহকে বিচার বিভাগের সহায়তায় কার্যে পরিণত করে। মূলত এটিই হলো আইনের শাসন। আইনের শাসনে সংবিধানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান সংবিধান মেনে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। আইনের শাসনের নীতি ও অভিব্যক্তি: আইনের শাসন হলো আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগ ও কর্তৃত্ব। রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে সকল বিষয় নির্ধারণের মানদ- হবে আইন এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান হিসেবে বিবেচ্য। প্রত্যেক নাগরিক যেমন তার কৃতকর্মের জন্য আইনের মুখোমুখি হবে তেমনি নিজেদের অধিকার ও দাবি আদায়ে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারবে। বিচার বিভাগকে আইন ও শাসন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত রাখতে হবে। আইন ব্যবস্থা জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার অনুকূলে হতে হবে। সুতরাং আইনের শাসনের একটি প্রয়োগিক ক্ষেত্র আছে এবং এটি একটি সার্বিক প্রক্রিয়া। আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা: একটি গণতান্ত্রিক দেশের গণতান্ত্রিক অবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান করে আইনের শাসন। আইনের শাসন দেশের গণতন্ত্রের ভিত্তিকে মজবুত ও গতিশীল করে; গণতন্ত্র চর্চার পথকে করে অবাধ ও উন্মুক্ত। আইনের শাসনের ফলে জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত হয়। আইনের শাসন বিরাজ করলে দেশে আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত হয়। আইনের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়। মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হয়। মানুষের বাক-স্বাধীনতা ও চিন্তা-বিবেকের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পায়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। সকল জনগণের সমানভাবে আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার নিশ্চিত হয়। আইনের শাসনের প্রয়োজনীয়তা তাই অপরিসীম। আইনের শাসন ও বাংলাদেশের সংবিধান: বাংলাদেশের সংবিধানে আইনের শাসনের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সংবিধানের ২৭ নং ধারায় বলা হয়েছে সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী। ৩২ নং ধারা অনুযায়ী আইনের বাইরে কোনো ব্যক্তিকে ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সরকার আইনের বাইরে কোনো নাগরিকের জান, মাল ও সম্মানের হানিকর এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করবে না। কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা প্রচলিত আইন মেনে করতে হবে এবং তাকে প্রচলিত নিয়মনীতি ও পদ্ধতি অনুসারে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বাংলাদেশে আইনের শাসনের বিভিন্ন দিক: বাংলাদেশ উন্নয়নশীল বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এদেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় বিদ্যমান সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা, আদর্শ সংবিধান, নির্বাচিত সরকার ও আইন পরিষদ এবং দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি থাকায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন একেবারে সীমিত। আমাদের আইনি কাঠামো, প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং রাজনৈতিক দল সবই যেন আইনের শাসনের প্রতিবন্ধক। এ দেশে আইনের উপর ব্যক্তির প্রাধান্য ও আইনের অসম প্রয়োগনীতি বিদ্যমান। এ দেশে পর্যাপ্ত আইন ও নীতিমালা বিদ্যমান থাকলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নেই। সর্বোপরি বাংলাদেশে আইনের শাসনের নীতিমালা শুধুই সংবিধানে লিপিবদ্ধ বাস্তবে সাধারণ জনগণের বেলায় তা সত্য বলে প্রতীয়মান হয় না। আইনের শাসনে আইন বিভাগের গুরুত্ব: আইন প্রণয়ন করা হলো আইন সভার প্রধান কাজ। দেশের নাগরিকের সকল ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে আইনসভার মাধ্যমে। আইন সভা কর্তৃক প্রণীত আইন অনুযায়ী শাসনকার্য ও বিচার কার্য পরিচালিত হয়। আইন সভা পুরাতন অনুপযোগী আইনগুলোকে বাতিল বা সংশোধন করে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে যুগোপযোগী নতুন আইন প্রবর্তন করে। বংলাদেশের আইন সভা আইন প্রণয়ন থেকে শুরু করে শাসনকার্য পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। বাংলাদেশে আইনের শাসনের প্রতিবন্ধকতাসমূহ: বাংলাদেশে আইনের শাসন একেবারেই নেই একথা বলা যাবে না। তবে যথাযথভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। আমাদের দেশের আইন প্রণেতারা তাদের সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার বিরুদ্ধে কেবলই দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে নিজ নিজ দলীয় স্বার্থে আইন প্রণয়ন করেন। আমাদের দেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পুলিশ বাহিনী আইনের অপপ্রয়োগ করে ভালো আইনকেও কলুষিত করে। এছাড়া নিম্ন আদালতের অনেক বিচারক, মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা বা দলীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির ক্রীড়ানক। নিম্ন আদালতে ঘুষ, দুর্নীতি আর শাসন বিভাগীয় হস্তক্ষেপের কারণে গরিব, অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষ ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হয়। বাংলাদেশে আইনের শাসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অন্তরায় বিচার বিভাগের উপর প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। এছাড়াও আইনের শাসনের অন্যতম বাধা হলো প্রশাসনিক দুর্বলতা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদের করণীয়: বাংলাদেশে আইনের শাসনকে যথাযথ রূপ দিতে হলে আমাদের সকলকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে হবে। আইন প্রণয়নকালে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। মূলত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আমাদেরকে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি নজর দিতে হবে- - প্রকৃত অর্থে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। - বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ন্যায়পাল নিয়োগ দিতে হবে। - পুলিশ বাহিনীর সংস্কার সাধন করে সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। - দেশের গণবিরোধী আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, কালো আইন বাতিল করতে হবে। - ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা ও ঐকমত্য থাকতে হবে। - সর্বোপরি আইন প্রণেতাসহ সকলকেই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। উপসংহার: আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে গেলে আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ ও বিচার বিভাগকে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সামনে এগুতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এজন্য দেশের জনগণকে আইনি শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষা এবং অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকেও জনগণের অধিকার ও আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে দায়বদ্ধ হতে হবে।